আমরা স্তম্ভিত ও ব্যথিত

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, রাজনীতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার দৃশ্যমানতা ও বিচরণ যেমন বিস্মিত করে সারা বিশ্বকে, তেমনি স্তম্ভিত ও ব্যথিত হতে হয় এ দেশের নারী নির্যাতনের হার, ব্যাপকতা ও কখনো কখনো নৃশংসতায়। প্রায়ই এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে বাংলাদেশে নারীরা আসলে কতখানি অগ্রগতির স্বাদ পেয়েছেন?

অনুমানের ওপর ভরসা না করে যদি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বলা যায়, দেশের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘদিন ধরে নারী সমাসীন। উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন নারীরা; প্রশাসন, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য-সর্বত্রই নারীর উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত। এমন দেশে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বা অগ্রসরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে গেল কেন? ওপরের চিত্রের পাশাপাশি যদি দেখতে হয় যে বাংলাদেশে ৮৭ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন, ৯২ শতাংশ নারী গণপরিবহনে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন, বাল্যবিবাহের হার এখনো ৫০ শতাংশের ওপরে রয়ে গেছে, তাহলে এ প্রশ্নের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা তোলা যায় না।

যে প্রশ্নটি ঘুরে ঘুরে আসে তা হলো, নারীর অবস্থানে এই বৈপরীত্য কেন? এর নানা রকম ও নানা মাত্রার কারণ দর্শানো যায়। তবে অন্যতম কারণ হচ্ছে, নারীর ওপর নির্যাতনকে নির্যাতন বলে অথবা একটি অপরাধ বলে মেনে না নেওয়ার পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গির প্রভাব, যা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এর ফলে সমাজে নারী নির্যাতন একটি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে এবং অভিযুক্ত বা অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে না বলে অপরাধ হ্রাসের কোনো কার্যকর পরিস্থিতি আমরা তৈরি করতে পারছি না। যে নারীরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন অথবা যাঁদের গণপরিবহনে হয়রানি বা নির্যাতন করা হচ্ছে, এই নারীরাই তোঅগ্রগামী, ক্ষমতায়িত নারীর পরিসংখ্যানে যুক্ত হচ্ছেন। তাই অনেক সংখ্যায় আপাতক্ষমতায়িত নারীদের দেখে আমরা বাংলাদেশে নারী অগ্রগতির একটি চিত্র আঁকছি। সেই চিত্রের কিছু অংশ কিন্তু আমাদের কাছে পূর্ণ সত্যটি তুলে ধরছে না।

এর পেছনের কারণ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বা আন্তরিকতার সঙ্গে নির্মূল করার জন্য যে আইনকানুন, প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, তার অনুপস্থিতি। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, নারীর ওপর যে নির্যাতন হয়, তার অধিকাংশই প্রকাশিত হয় না। সংবাদ হিসেবে যে নির্যাতনের ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি, তার সব কটির অভিযোগ হয় না, অভিযোগ পাওয়া সব ঘটনার মামলা হয় না। তার চেয়েও বড় কথা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যে ঘটনাগুলোকে মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তার বিচারের চিত্র অত্যন্ত করুণ ও হতাশাব্যঞ্জক।

নারীর অভিযোগে মামলা গ্রহণে অনীহা, মামলা নিলে তদন্তে গাফিলতি বা ভুল, প্রযোজ্য নয় এমন ধারায় মামলা দায়ের করা, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ ও আদালতে উপস্থাপন করায় ত্রুটি, সাক্ষী হাজির না করা, সরকারি কৌঁসুলিদের আন্তরিকতার অভাব, কখনো কখনো দুর্নীতি-এ সবকিছু নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, যৌন পীড়ন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা-এসব অত্যন্ত গর্হিত, ভয়ানক অপরাধের জন্য যতটা মামলা হয়েছে, তার ৩ শতাংশের কম ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। ৫০ শতাংশের অধিক অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেয়েছেন বলে তথ্য আছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অভিযুক্ত ব্যক্তি অব্যাহতি পেয়ে যান। যাঁদের শাস্তি হয়, নানা বিচারিক প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে তাঁরা নির্যাতিতকে আবারও বিপদগ্রস্ত করেন, এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। অনেক মামলা ভুল ধারায় দায়ের করায় সেগুলো ভুয়া প্রতিপন্ন হয়, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপসের কথাও শোনা যায়। এ সবকিছু মিলে নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার শুধু উপেক্ষিত নয়, প্রকারান্তরে অস্বীকৃতই থেকে যায়। তাই অনেক নতুন নতুন আইনকানুন, প্রক্রিয়াগত সংস্কার, নানা ব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও নারী নির্যাতনের হার ও ভয়াবহ প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে এই ব্যবস্থার যে প্রান্তে যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন, প্রত্যেককে তাঁর দায়িত্ব আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে পালন করা নিশ্চিত করতে হবে। যে কেউ এর যেকোনো পর্যায়ে গাফিলতি, দুর্নীতি বা অদক্ষতার পরিচয় দিলে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে জবাবদিহির সম্মুখীন করতে হবে এবং তাঁর প্রাপ্য শাস্তি দিতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধ করা যে শুধু নারীর নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য নিশ্চিত করতে হবে তা নয়, এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, যা আমরা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের আখরে লিপিবদ্ধ করেছি।

সুলতানা কামাল: মানবাধিকারকর্মী