নারীকে বিকশিত হতে দিন

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কবিতাটি তিনি শেষ করেছিলেন এভাবে, ‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’ কিন্তু সে ‘সুদূর নয়’ যে আসলে কত দূর, তা আজও আমাদের অজানা। আজও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, স্বীকৃতিবিহীন নারীর শ্রম, পারিবারিক সহিংসতা, অর্থ-সম্পত্তির ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণহীনতার বিষয়গুলো নারীর ক্ষমতায়িত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত ব্যাহত করে চলেছে।

প্রতিবছর ৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।। দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে উচ্চারিত হয় নারী-পুরুষ সমতা এবং নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের প্রত্যয়। দিবসটির সূত্রপাত হয় ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমঘণ্টা ১৬ থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নসহ নানা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীকালে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা জায়গায়। জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। এরপর থেকে প্রতিবছরই দিনটি নানা আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে।

প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্বে নারী দিবস পালিত হয়। প্রতিপাদ্যগুলোর মূল কথা থাকে নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন দূর করা। সেই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিতে। কিন্তু আজও আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। এখনো নারীর প্রতি বৈষম্য ও অন্যায়ের ভয়াবহ চিত্র নারীর অগ্রযাত্রাকে যেন মন্থর করে দিচ্ছে। আমাদের দেশে নারীর বিভিন্ন অর্জন একদিকে যেমন আমাদের আশাবাদী করছে, অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের নানা উদাহরণ এই অর্জনকে অনেকটাই ম্লান করে দিচ্ছে কিংবা করছে প্রশ্নবিদ্ধ।

উদাহরণ হিসেবে বাল্যবিবাহের উচ্চ হারের প্রসঙ্গ বারবার সামনে চলে আসে। আমাদের দেশে এ হার ৫২ শতাংশ, যা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ (ইউনিসেফ স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন ২০১৬)। আছে সংসারজীবনে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হওয়ার উচ্চ হার। আমাদের দেশে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক জরিপ ২০১৫)। ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির অধীনে গত বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের ৫৬টি জেলায় তৃণমূল পর্যায়ে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে যত নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তার প্রায় ৭৭ শতাংশই হয় পারিবারিক পরিসরে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামীরাই স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালান। গৃহনির্যাতনের ফলে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা জাতীয় ব্যয়ের ১৩ শতাংশ (ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন: কস্ট অব দ্য ন্যাশনস; ইউএসএইড, কেয়ার বাংলাদেশ ২০১৪)।

আমরা নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি রাস্তায়, গণপরিবহনে, এমনকি উন্মুক্ত স্থানেও। গণপরিবহনে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে অহরহ। অ্যাকশনএইডের উদ্যোগে বিশ্বের ১০টি শহরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ নারী গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

বাংলাদেশে এখনো নারীর পুনরুৎপাদনমূলক শ্রম স্বীকৃত নয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা তাঁদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে নারীর কাজের আর্থিক মূল্যের স্বীকৃতির সঙ্গে নারীর মর্যাদা ও ÿক্ষমতায়নের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর অভাবে নারীর কাজ সমাজ ও পরিবারের কাছে মর্যাদাপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় না। নারীর প্রতি সহিংস আচরণের ঘটনাগুলোয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার ব্যাপারেও নারী অধিকারকর্মীরা বারবার জোর দিয়ে আসছেন।

নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পুরুষের অংশগ্রহণ। পুরুষের ইতিবাচক অংশগ্রহণ ছাড়া নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন যে সম্ভব নয়, এ উপলব্ধি আমাদের দেশে যেমন, তেমনি সারা বিশ্বে বিভিন্ন স্তরের মানুষ আরও গভীরভাবে অনুভব করছে। আর তাই পুরুষের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষার এবং মূল্যবোধ চর্চার একটি ভূমিকা আছে, তা আমরা সবাই জানি। পরিবারই সব শিক্ষার সূতিকাগার। যে সন্তান পরিবারে নারীকে সম্মানিত হতে দেখে, সে সহজাতভাবেই নারীকে সম্মান করতে শেখে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীরা যেভাবে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছেন, তা আমাদের আশাবাদী করে, আমাদের প্রত্যয় জন্মায় যে সামনের দিনগুলোতে নারীরাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি, বিশেষ করে রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন অনেক উন্নত দেশের জন্যও ঈর্ষণীয়। নারীর ক্ষমতায়নের এই যুদ্ধে সরকারের পাশে সব সময়ই ছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। এসব সংগঠন নারীর অধিকার আদায় ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় শহরে-গ্রামে আজও সমানতালে কাজ করে চলেছে।

প্রতিবছর নারী দিবসে যেসব প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, সেগুলো কেবল এক দিন পালনের বিষয় নয়। এসব প্রতিপাদ্যের প্রতিটি নিরন্তর চর্চার বিষয়, বিশেষ করে সমাজের সেই স্তরে যেখানে নারী আরও অবহেলিত, বঞ্চনার শিকার। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে নারী অধিকারের চিত্রটি বেশি মলিন, তাই সেখানেই নারী অধিকারের বার্তা আরও জোরের সঙ্গে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, ব্যক্তি খাতে সবাই নানাভাবে একযোগে কাজ করে চলেছে। গ্রামাঞ্চলের এই বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশে এ বছর নারী দিবসের মূল ভাবনায় গ্রাম ও শহর উভয় অঞ্চলেই নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্ব তুলে ধরার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে।

নারী আপন আলোয় উদ্ভাসিত, অমিত সম্ভাবনার আধার। তিনি ধৈর্যশীল, মমতাময়ী, বুদ্ধিমতী, চৌকস, দুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী। এত গুণাবলির সমন্বয়ের সম্মুখে অসম্ভব বলে আর কিছু থাকে না। কিন্তু সেই গুণাবলির সার্থক বিকাশে চাই উপযুক্ত ক্ষেত্র আর ন্যূনতম সুযোগ। সেই ক্ষেত্রে আর সুযোগের উন্মেষ হতে পারে যদি পুরুষ আর নারী, প্রত্যেকে আমরা একটু একটু করে বিশ্বাস করতে শুরু করি নারীর বিকাশ মানে পুরুষেরও বিকাশ, পুরুষেরও কল্যাণ।

আন্না মিনজ: ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন, সমন্বিত উন্নয়ন এবং জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির পরিচালক