তফসিলের আগের ও পরের বৈধতার প্রশ্ন

নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার চলমান বিতর্ক নির্দেশ করছে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকালে কী রকম আচরণ করবে, তা নিয়ে কখনো কার্যকর আলোচনা হয়নি। নির্বাচনী আইনে ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য যে বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তার সবটাই তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত কার্যকর হবে। সুতরাং বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের যে দাবি তুলেছেন, তা আক্ষরিক অর্থে সঠিক বলা চলে না।

মওদুদ আহমদকে টেলিফোনে এ বিষয়ে যুক্তি দিতেই তিনি স্বীকার করলেন যে প্রয়োজনে আইনে সংশোধন আনতে হবে। তাঁর কথায়, কিন্তু সব সুবিধা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ভোট চাইছেন, তা অনৈতিক। প্রধানমন্ত্রী যখন ভোট চাইছেন, তখন বিএনপিকে ঘরোয়া সভা করতে পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। আর নির্বাচন কমিশন এর কোনোটিরই প্রতিকার দিতে ব্যর্থ।

আমরা স্মরণ করতে পারি যে মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচনের পর যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল, তখন তা মোকাবিলায় বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায়, সে জন্য কিছু আইনি সংস্কার করেছিল, কিন্তু তা তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের কাছে সংগত কারণেই যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়নি। কারণ, বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো নির্বাচিত-অনির্বাচিত ব্যক্তিদের অজুহাত দেখিয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, যাতে দলীয় সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তৈরি হতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বিএনপি ক্ষমতাসীন অবস্থায় নানা কলাকৌশল খাটিয়ে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার চিন্তায় বুঁদ ছিল। এরপর তারা অসহায় অবস্থায় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস করেছিল।

সুতরাং ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর দলীয় সরকারের অধীনে উপযুক্ত নির্বাচনী সংস্কার আনা এবং তার ফলাফল কী হতে পারে, সেই পরীক্ষায় না গিয়ে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেছিলাম। এরপর ২০০৬ সালে পুতুল ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের হাতে নামকাওয়াস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিএনপি প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যের কর্মকাণ্ড দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কবর রচনা করেছিল। আবার একইভাবে আওয়ামী লীগ মোটামুটি ওই একই ধরনের অজুহাত খাড়া করে তাদেরই আন্দোলনের ফসল এবং বিশ্বের দেশে দেশে তাদের অসামান্য উদ্ভাবন (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) হিসেবে দাবি করা পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন কীভাবে ভারত, ব্রিটেনসহ উন্নত গণতন্ত্র করে থাকে, তার সপক্ষে তারা প্রায়ই সঠিক যুক্তি দিয়ে থাকে, কিন্তু তা বহুলাংশে খণ্ডিত। ওই সব দেশে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নিজেই গোটা মন্ত্রিসভাকে নিয়ে কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানে রূপান্তরিত হন, সে বিষয়ে খোলামন নিয়ে আলোচনা করতেও ক্ষমতাসীন দলের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কম নয়।

অথচ একটি যোগ্য জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে আমাদের উচিত হবে দলীয় সরকার যে নির্বাচনে জয়ী হতে মরিয়া হয়ে ওঠে না, সেটা প্রমাণ করা। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। কার দোষ বেশি, কার কম, সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু বিশ্ব দেখছে যে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন একটি পরিবেশে, যখন বাংলাদেশ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে কি না, তা গুরুতরভাবে প্রশ্নের মুখে। প্রধান বিরোধী দলের দুর্বলতার কারণে কোনো একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ টেকসই নয়, বরং আরও বেশি ভঙ্গুরই থেকে যেতে পারে।

বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন ও একতরফা নির্বাচনের পরিস্থিতি থেকে সরে এসে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। ওই নির্বাচন বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। একটি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা এবং রোহিঙ্গা সংকট, তিস্তা চুক্তি না হওয়া, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতেই হবে।

ত্রিপুরার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক বিজেপির হাতেই বাম দুর্গের পতন ইঙ্গিত করছে যে এটা একটা ঢেউ, যা গোটা বাংলাদেশের সীমান্ত ছুঁয়ে যাওয়া ভারতের অবশিষ্ট রাজ্যগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে। কল্পনা করুন, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলোতে বিজেপি সরকার গঠন করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য তা এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি ভেতরে-ভেতরে ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে, তাহলে বিদেশনীতির মৌলিক ইস্যুগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশের দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে, না কমবে? আরও একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন কিংবা কার্যত আরও একটি বিতর্কিত বা অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মর্যাদাকে আরও ক্ষুণ্ন করবে।

প্রতিপক্ষকে সুযোগের সমতা দিয়ে নজির স্থাপন করার কাজটি তাই আওয়ামী লীগের তরফে জরুরি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা মানে সরকার ও দলকে এক করে ফেলা নয়। সরকার না চাইলে বিএনপি খুশি হবে বা আওয়ামী লীগ বিব্রত হবে এমন কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নেওয়ার বাস্তব পরিস্থিতি রয়েছে কি না, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। প্রধানমন্ত্রীর ভোট চাওয়ার ব্যাপারে বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে যে চিঠি দিয়েছে, সে বিষয়ে তারা নীরব। কিন্তু তারা অক্ষম অজুহাত দেখিয়েছে যে আইনে তার হাত-পা বাঁধা। প্রকৃতপক্ষে যা তফসিলের পর অবৈধ, তা আগে আরও বেশি অবৈধ। ভারত গত ৭০ বছরে কয়েকটি নির্বাচন লোকসভা না ভেঙে (চারটির বেশি নয়) করেছে, প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে এই তথ্য জেনে আওয়ামী লীগের উৎফুল্ল একজন নেতা আমাকে বলেছিলেন, ‘সংসদ রেখে নির্বাচন করার উদাহরণ আমরা পেয়েছি।’ সেই নেতার উদ্দেশে বলতে চাই, ভারতের নির্বাচনী আচরণবিধিতে যা আছে, তা-ও মেনে দেখান।

ভারতে কংগ্রেস শাসনামলে মৌলবাদী বিজেপির সভা-সমাবেশ করার অধিকার ছিল। তারা বড় ধরনের কোনো চাপ, ভয়ভীতি ছাড়াই প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়েছিল, মূল প্রতিপক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিল বা বিজেপিকে এ জন্য অহর্নিশ ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছিল-এমন কিছু আমরা স্মরণ করতে পারি না। বরং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশন পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে কী করে দলীয় সরকারের অবাঞ্ছিত ও অনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করার সব উপায় উদ্ভাবন করেছে।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১ সালে নির্বাচিত হওয়াকে চার বছর পর অবৈধ বলা এবং পরের আরও ছয় বছর তাঁকে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য করে দেওয়া এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় আজ সোনার হরফে লেখা। ভারতীয়রা গর্বিত। আর সেই রায়ের কারণে ইন্দিরার জরুরি অবস্থা জারির ঘটনা ভারতের গণতন্ত্রের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ইন্দিরা গান্ধীকে দুটি কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। উত্তর প্রদেশ সরকারের গেজেটেড অফিসারদের এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে স্পেশাল ডিউটিতে থাকা গেজেটেড কর্মকর্তা যশপাল কাপুরকে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই, দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত ভারতের নির্বাচনব্যবস্থা গড়তে এ ধরনের বহু রায় ভূমিকা রেখেছে এবং ক্ষমতাসীনেরা তা মেনেছেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৯ (সংসদ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করবে ইসি) ও ১২৬ (ইসির দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সরকারের কর্তব্য) অনুচ্ছেদ এবং এই বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মাইলফলক রায়গুলোর আলোকে আমরা বলতে পারি, বিএনপির ওই চিঠির প্রেক্ষাপটে ইসি সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারে।

আমরা সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের (অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার) সঙ্গে একমত যে আওয়ামী লীগকে তিরস্কার না করেও এ রকম পদক্ষেপ ইসি নিতে পারে, আর তাতে সরকার বিব্রত হয়ে সংযত হতে পারে। অবশ্য ইসির উচিত হবে নির্বাচনী বছরে সরকারের জন্যই কার্যকর একটি আচরণবিধি তৈরি করা।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]