বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তন

>

ফিরে দেখা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এবারের বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার-২০১৭ পেয়েছেন ড. আজিজুর রহমান খান ও ড. মাহবুব হোসেন (মরণোত্তর)। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ড. আজিজুর রহমান খান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে ছাপা হলো। উল্লেখ্য, ড. আজিজুর রহমান খান বর্তমানে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইডের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। উন্নয়ন অর্থনীতি, বিশেষ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা, কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও ভূমি সংস্কার এবং আয় বণ্টন ও অসমতা বিষয়ে গবেষণায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত পাঁচ বা ছয় দশকে বিশ্বে যতখানি উন্নয়ন হয়েছে, মানব ইতিহাসের আর কোনো সময় ততটা হয়নি। আমি এই সময়ের নাম দিয়েছি ‘আমাদের আমল’। এই রূপান্তরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বিশ্বের সেই সব অংশে, যেগুলোতে শিল্পবিপ্লবের প্রথম দুই শতকের ছোঁয়াই লাগেনি।
আমাদের প্রজন্ম উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে বিশ্বের যে অংশকে চেনে, একুশ শতকে সেই অংশেই আনুপাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি বস্তুগত অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রগতি বহুমাত্রিক: মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, স্বাস্থ্য ও সাক্ষরজ্ঞান বাড়া, তীব্র দারিদ্র্য ও চরম দুর্দশা আনুপাতিক হারে কমে আসা এই অগ্রগতির প্রধান দিক। অতিসাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিস্ময়কর ধারাবাহিকতায় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ঘটেছে। ট্রাম্পের উত্থানকে কেন্দ্র করে হইচই, ইউরোপ ও তার আশপাশের দেশগুলোর উপকূলে শরণার্থীদের ভাসমান মৃতদেহের বীভৎস দৃশ্য, সন্ত্রাসবাদের অবিরাম তৎপরতা, দেশে দেশে যুদ্ধ-সংঘাতের ফলে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ-এসব সত্ত্বেও উল্লিখিত মানব উন্নয়নের সূচকগুলোর নিরিখে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জনের বছর হলো ২০১৭ সাল।
এসব সমস্যার মধ্যেও আমাদের এই সময়কাল যে অর্জন ও অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করল, তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। এই বিষয়সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আমি তুলে ধরতে চাচ্ছি। অর্থনীতিবিদেরা সুদীর্ঘকাল ধরে উৎপাদন-সম্ভাব্যতা নিয়ে যে ধারণার ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন, সেটি হলো বিদ্যমান সম্পদ ও মেধা দিয়েই সর্বোচ্চ উৎপাদন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। সমৃদ্ধি ও উৎপাদন-সম্ভাব্যতা রেখা যেটাকে বলা যেতে পারে, বিশ্বের বস্তুগত সমৃদ্ধির ধারা তার অনেক নিচে রয়েছে। তবে আমাদের সমাজগুলোকে আরও সুন্দরভাবে সংগঠিত করে বিদ্যমান জ্ঞান ও মেধার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ নিশ্চিত করা যায় এবং অনর্থক সংঘাত এড়ানো যায়, এমন নীতি গ্রহণ করে সমষ্টিগত সমৃদ্ধি ও এর ক্রমবৃদ্ধি আরও বাড়ানো যেত। এর সত্যতা প্রমাণ করতে আমাদের এই উপমহাদেশের বাইরে তাকানোর দরকার নেই। দেখা যাবে, এই অঞ্চলের দেশগুলো নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য সীমিত করে, পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে এবং এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অস্ত্রের মজুত বাড়িয়ে সমষ্টিগত সমৃদ্ধির গতি নামিয়ে ফেলেছে।
দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দ্রুত প্রবৃদ্ধির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কম-বেশি সবখানেই আয় বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে যাওয়া। আমি এ বিষয়ে প্রায়ই দুটি গতানুগতিক বিরোধিতার মুখোমুখি হই: ১. যেহেতু বেশির ভাগ আয় বৃদ্ধি হয়েছে দরিদ্রতর দেশগুলোতে, সেহেতু মনে হয় বিশ্বের সব ব্যক্তির মধ্যে আয় বণ্টনের অসমতা হয় কমেনি, নয়তো কমলেও তা খুবই কম। ২. চরম দারিদ্র্য যেখানে কমতির দিকে, তখন বৈষম্য বাড়ায় কারও উদ্বেগ থাকবে কেন?
এ দুই যুক্তির কোনোটিই মানতে আমি রাজি নই। আমাদের কাছে এমন কোনো সন্তোষজনক প্রমাণ নেই, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে একেকটি দেশের ভেতরের বৈষম্যকে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্যের মাধ্যমে পুষিয়ে আনা যায়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি দেশের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বৈষম্য সমাজকাঠামো কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়: যেমন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অভ্যন্তরীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান এই বৈষম্যই ঠিক করে দেয়।
চরম দারিদ্র্য কমতে থাকার পরও বৈষম্য বাড়ায় কারও উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ এই যে সামগ্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে দারিদ্র্য হ্রাসের চেয়ে বৈষম্য বড় বাধা সৃষ্টি করে। এরপর আরও একটি উদ্বেগের কারণ হলো, বিদ্যমান আয় নিরূপণের হিসাব পদ্ধতি বহু খরচের খাতকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে বিশাল ক্ষতি, সেটি এই হিসাবের মধ্যে ধরা হচ্ছে না।
আয় বণ্টনের হেরফের সমন্বয় করতে অর্থনীতিবিদেরা একটি পন্থা অবলম্বন করেন। সমষ্টিগত আয়কে ‘সুষমভাবে বণ্টিত সমমূল্যের আয়ে’ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তাঁরা এই সমন্বয় করেন। যদিও ভিন্ন ভিন্ন স্তরের জীবনমানে থাকা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত আয়ের একক তাদের সমাজ কীভাবে মূল্যায়ন করে, তা বিবেচনায় আনা খুবই জরুরি।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় করতে হয়, তা-ও অর্থনীতিবিদেরা জানেন। যেমন বনজ সম্পদ ও পানির উৎসের ক্ষতির মতো কিছু বিষয়ে কী করতে হবে, তা স্পষ্ট। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের মতো কিছু বিষয়ের ক্ষতি নিরূপণের জন্য আরও বেশি তথ্য এবং কোনো সমাজব্যবস্থা প্রত্যাশিত গড় আয়ু ও রুগ্ণতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে, তা আমলে নিতে হয়। আমি মনে করি, প্রাথমিকভাবে পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা অতি দুরূহ হিসেবে প্রতীয়মান হলেও এটিকে অপেক্ষাকৃত কম ভীতির বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে মূল্যায়ন করা উচিত।
মূল ব্যাপার হচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের বিপরীতে সমন্বয়কৃত সুষম বণ্টনলব্ধ আয় আমাদের সময়ের, বিশেষ করে আমাদের দেশ, চীন ও ভারতের মতো দেশে, উচ্চ প্রবৃদ্ধির শতকরা হার কমিয়ে ফেলবে। এমনকি এই সমন্বয়ের পরও আমাদের আমলে অর্জিত হতে থাকা সমৃদ্ধির বিকাশ অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক হবে; তবে দাপ্তরিক আনুমানিক মূল্য বিচারে সম্ভাব্য অর্জনকে যতটা জমকালো হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তার থেকে সেই অর্জন কিছুটা কম হবে।
এখন দেখা যাক সমৃদ্ধির ক্রমবৃদ্ধি নিরূপণের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া কী অবস্থায় আছে। কর্মজীবনের শুরুতে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যে আদর্শের প্রভাবশালী ধরন ছিল সোভিয়েত কেন্দ্র-নির্দেশিত পরিকল্পনার ধরন। তাঁদের সামনে আশার বিষয় ছিল, এটি অত্যন্ত দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও সাম্যের মিশ্রণ ঘটায়। যেমনটা ঘটেছিল সোভিয়েতে। গভীর হতাশায় পুঁজিবাদী বিশ্ব যখন পঙ্কিল হয়ে উঠেছিল, সেই মুহূর্তে সোভিয়েত অর্থনীতির ক্ষিপ্র অগ্রগতি এবং শ্রমের শোষণ বন্ধ ও সাম্য নিশ্চিতে পুঁজির বেসরকারি মালিকানা বিলুপ্ত করার অঙ্গীকার তাঁদের সামনে আশাজাগানিয়া ভূমিকা রেখেছিল।
আমাদের কর্মজীবন শেষের বহু আগেই কেন্দ্র-নির্দেশিত পরিকল্পনাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। জনগণের বস্তুগত আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতার জন্য অনিবার্যভাবে দায়ী হয়ে উঠেছিল যে বিষয়টি, সেটি হলো সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের জন্য অপরিহার্য প্রচলিত যুক্তিগ্রাহ্য অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের পদ্ধতি থেকে বিচ্যুতি।
নিজেকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ অর্থনীতিবিদ মনে করতেন, এমন ব্যক্তিসহ বহু অর্থনীতিবিদ এর কারণ বিশদভাবে পর্যালোচনা করেছেন। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে তা নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ নেই। আমি যা বলতে চাই, তা হলো সোভিয়েতের কেন্দ্র-নির্দেশিত পরিকল্পনাব্যবস্থাও সন্তোষজনক সাম্যবাদী সমাজ গড়তে পারেনি। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর জন্য তৈরি করা অসংখ্য হিসাবে দেখা যায়, তাদের বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর চেয়ে কম ছিল বটে; কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে ছিল বেশি।
এর কারণ হিসেবে নানা ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে আমি যেটির ওপর জোর দিতে চাই সেটি হলো ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত করে সরকারের অধীনে উৎপাদন হলে বৈষম্য দূর হবে-জনগণের মধ্যে এই আশা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিমালিকানায় কলকারখানা থাকাটাকে পুঁজিবাদী শোষণের উৎস বলে বিবেচনা করা হয় এবং উনিশ শতকের বাস্তবতায় হয়তো মার্ক্সের কথা ঠিকই ছিল।
কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদে পুঁজির মালিকানা আর এক জায়গায় পুঞ্জীভূত থাকার সুযোগ নেই। এখনকার পুঁজি ছড়ানো-ছিটানো থাকে। পাল্টে যাওয়া আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরনের কারণেই শীর্ষ ব্যবস্থাপকেরা সম্পূর্ণ আয় কুক্ষিগত করতে পারে না। যোগ্যতামাফিক কর্মীদের মধ্যে তা বণ্টন করতে হয়। সোভিয়েত ঘরানার সমাজতন্ত্র উৎপাদন কারখানার ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত করেছিল। সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে সেগুলোর ওপর আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। তখন দেখা গেল, সেগুলো কার্যত সরকারের অনুগত ব্যক্তি অথবা সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো গ্রুপ চালাচ্ছে। ব্যবস্থাপনাভিত্তিক পুঁজিবাদের চেয়ে এই ব্যবস্থা ভালো ছিল, এ কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
কেন্দ্র-নির্দেশিত পরিকল্পনার বিকল্প হচ্ছে এমন এক বাজারের ওপর নির্ভর করা, যেটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অন্যতম অঙ্গ। কিন্তু গণতন্ত্রে পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান বলতে যা বোঝানো হয়, আধুনিক বাজার আর সেই জায়গায় নেই। এমনকি চরম বিশুদ্ধতাবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব পর্যন্ত আধুনিক বাজারের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েছে। আধুনিক বাজারকেও যেসব সীমাবদ্ধতার মুখে পড়তে হয় সেগুলো হলো সবার জন্য তথ্য পাওয়ার সমান সুযোগের অভাব, সরাসরি বিনিয়োগকৃত পুঁজির বাইরে আরও যেসব পুঁজি ও সম্পদমূল্য আছে, সেগুলোকে হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সর্বোপরি বাজারে সক্রিয় বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে সম্পদের বৃত্তির বণ্টনবৈষম্য।
আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের মধ্যেই পুঁজিবাদের অধীনে বাজারের এই অসাম্যের কারণ নিহিত রয়েছে। যখন বৈষম্য সীমিত পর্যায়ে নেমে আসে এবং অন্য ব্যর্থতা পুষিয়ে নিতে ক্ষতিপূরণমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই বাজার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আসলে এটিই সম্পদের লাগসই ব্যবহার নিশ্চিত করার একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি।
বাজারকে বাতিল বা পরিত্যাগ করা মানুষের কথোপকথনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপেরই নামান্তর। কিছু লোক আছে, যারা এত উচ্চ স্বরে কথা বলে যে তাদের কণ্ঠের নিচে কম শব্দ করে অন্যদের বলা কথা চাপা পড়ে যায়। সেই কথাগুলো ঠিকমতো শোনা যায় না। এখানে ন্যায্য সমাধান হবে উচ্চ স্বরে কথা বলা লোকদের আওয়াজ একটু কমিয়ে দেওয়া, যাতে অন্যদের কথাও বোঝা যায়। বাজারের বিষয়টি অনেকটা তেমনই।
বেশির ভাগ অর্থনীতিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে উৎসারিত আয়ের প্রাথমিক বণ্টনকে সুনির্দিষ্ট পুনর্বণ্টন নীতি আবার হিসাব-নিকাশ করে আরও সীমিত করে আনে। অক্সফোর্ডের গবেষণায় কয়েকটি দেশের প্রাক্পুনর্বণ্টন ও পুনর্বণ্টনোত্তর আয়বৈষম্যের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, যেসব দেশ প্রাক্পুনর্বণ্টন ও পুনর্বণ্টনের আয়বৈষম্য যত বেশি কমিয়ে আনতে পেরেছে, সেসব দেশ তত বেশি অর্থনৈতিক সমতা অর্জন করতে পেরেছে।
এ কারণে আমার যৌবনে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা কেন্দ্র-নির্দেশিত পরিকল্পনাভিত্তিক অর্থনীতির মৃত্যুতে আমি অশ্রুপাত করি না। এ নিয়ে আমার কোনো শোক-তাপ নেই। তার বদলে আমি এই ভেবে আনন্দ পাই যে বিশ্ব এখন একটি নতুন ধরনের সমাজতন্ত্র পেয়েছে, নতুন ধরনের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র পেয়েছে, যা অর্থনৈতিক দক্ষতা ও সমতার মিশ্রণ ঘটিয়েছে।
সুনির্দিষ্ট পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে আনা অবশ্য খুবই কঠিন কাজ। এর জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের দরকার হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দেশগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠান থাকলেও উন্নয়নশীল দেশে খুবই দুর্লভ। এ কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত এমন নীতি প্রণয়ন করা, যার মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময়ই অপেক্ষাকৃত বেশি সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এটি করতে হলে যা দরকার: কর্মসংস্থানের ব্যাপক বৃদ্ধি, বেতন যাতে সব পর্যায়ে সন্তোষজনকভাবে বাড়ে সে জন্য উৎপাদনে প্রতিযোগিতা বাড়ানোয় উৎসাহ দেওয়া, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বেশি বেশি সুযোগ দেওয়া এবং দরিদ্রদের বৃত্তি দেওয়া বাড়ানো।
অক্সফোর্ডের যে গবেষণার কথা আমি ওপরে উল্লেখ করেছি, তাতে দেখা গেছে যে সুনির্দিষ্ট পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে বৈষম্য অনেকখানি কমিয়ে সমতার সূচকে অনেক ওপরের দিকে গেছে দক্ষিণ কোরিয়া। পূর্ব এশিয়ার আদি বাঘ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোকে অবশ্যই একইভাবে সমতা অর্জন করতে হবে। আমাদের মতো সমকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ খুঁজতে তাদের কাছ থেকে শিখতে হবে।

আজিজুর রহমান খান, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইডের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর