নারী লাঞ্ছনা ও রাজনীতি

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই প্রথমবারের মতো ২৪ ঘণ্টার একটি ধর্মঘট করেছেন স্পেনের নারীরা। নারী-পুরুষের বৈষম্য এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তাঁদের এই ধর্মঘট। তাঁদের স্লোগান ছিল, ‘আমরা যদি থেমে যাই, বিশ্ব থেমে যাবে’।

নারী দিবস পালনের বিষয়ে ইউরোপ সব সময়ই অনেক এগিয়ে। তবে ইউরোপীয় কোনো দেশে দিবসটি পালনে ধর্মঘটের ঘটনা এই প্রথম। এমনিতেই এ বছরের নারী দিবসে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল যৌন নির্যাতন ও শোষণের বিষয়টি। হলিউডের তারকাদের ‘আমিও নিপীড়নের শিকার’ বা ‘মি টু’ আন্দোলনের পটভূমিতে যৌন নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এসব দেশে এখন তুঙ্গে। পাশাপাশি এসেছে নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্যের বিষয়টিও। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর মেয়েদের কম মজুরি দেওয়ায় পাওনা পরিশোধে এখন রীতিমতো নাকাল।

আর সেই বিশ্ব নারী দিবসের দিনটিতে বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পটভূমিতে দিনটি উদ্যাপনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশের পথে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের হাতে কয়েকজন ছাত্রী-তরুণী নানাভাবে হেনস্তা হওয়ার অভিযোগ করেছেন। একজন ছাত্রী রাগ-ক্ষোভ ও দুঃখে দেশ ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এঁদের অধিকাংশই তাঁদের লাঞ্ছনা ও কষ্টের কথা জানিয়েছেন ফেসবুকে।

লাঞ্ছনার শিকার এসব কিশোরী বা তরুণী ন্যায়বিচার পেলে হয়তো তাঁরা কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসব ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই যে রাজনীতি শুরু হয়েছে, তাতে সেই সম্ভাবনা লোপ পাওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। আলোচিত ছাত্রীদের কেউ কেউ তাঁদের বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তা সরিয়েও নিয়েছেন। তবে তা সরিয়ে ফেলার আগেই তার যে কতগুলো স্ক্রিনশট ছবি আকারে অন্যরা নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করেছেন, তার হিসাব পাওয়া দুষ্কর। রাজনীতির প্রসঙ্গ একটু পরে। তার আগে নারী নির্যাতন ও বিচারহীনতার সামগ্রিক চিত্রটা কত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা একটু দেখে নেওয়া যাক।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনেই জানা গেল যে শুধু ঢাকায় নারী ও শিশু অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৫ বছরে যত মামলা হয়েছে, তার ৯৭ শতাংশের আসামিরা কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে গেছে। এসব মামলার আসামিদের অধিকাংশই বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে। এমনকি এ সময়ে ধর্ষণের মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহারের মতো নজিরও তৈরি হয়েছে। প্রথম আলো ঢাকার ছয়টি ট্রাইব্যুনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার প্রাথমিক তথ্য যাচাই করে দেখেছে, ওই সময়ে মাত্র তিন শতাংশ মামলায় অপরাধীর সাজা হয়েছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের জন্য হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌন পীড়নের মতো ছয়টি অপরাধের বিচারের চিত্র হচ্ছে এটি। সারা দেশের চিত্র যে এর থেকে উন্নত কিছু হবে, এমনটি মনে করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বরং সংবাদমাধ্যমের নজরদারির বাইরে থাকায় সেসব জায়গার পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

নারী দিবসের আগের দিন জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানাল, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার এখন ৫৯ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে এবং বিশ্বে চতুর্থ। ২০১১ সালের সরকারি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সে সময়ে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৫২ শতাংশ। সরকার অবশ্য ইউনিসেফের পরিসংখ্যান গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে, বাল্যবিবাহ আগের তুলনায় কমেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখনো এই হার ৫০ শতাংশের ওপরে। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ যে পিছিয়ে পড়েছে, সে বিষয়ে বিতর্কের তেমন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। সর্বব্যাপী বিরোধিতা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ নিরোধের আইনে যে সংশোধনী যুক্ত করা হয়েছে, তাতে কিশোরীদের ওপর যৌন অপরাধ সংঘটন এবং আপসরফার সুযোগ থাকায় বাল্যবিবাহ নিরোধের সামাজিক আন্দোলন যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার আলামত এখন স্পষ্ট।

এই দুটি চিত্র যদি কারও মন খারাপের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তাঁকে আরও একটু শক্ত হতে বলব। কারণ, পরের পরিসংখ্যানগুলো মেনে নেওয়া আরও কঠিন। গত মঙ্গলবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গণপরিবহনে চলাচলের সময় কোনো না কোনো সময়ে মৌখিক, শারীরিক এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৯৪ শতাংশ নারী। আবার এসব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ৬৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা। যার মানে দাঁড়াচ্ছে নারীদের নিগৃহীত করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরাট একটি অংশেরই সম্ভবত পরিবার আছে, তারা অবিবাহিত তরুণ নয়।

বছর তিনেক আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক পারিবারিক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, দেশের ৮৭ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে গণমাধ্যমে পাবিরারিক সহিংসতার যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তাতে নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা আরও বেড়েছে বলেই আভাস পাওয়া যায়।

নারী নির্যাতন ও নারীদের প্রতি অপরাধগুলোর বিচারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি খুব সামান্যই। তনু হত্যার মতো বহুল আলোচিত অনেক হত্যাকাণ্ডেরই কোনো বিচার হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনাতেও প্রশাসন ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষণীয়। আর শিক্ষাঙ্গনের বাইরে দুর্বৃত্তরা আইনকে যে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে, সেটাও সম্ভব হচ্ছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। যে দেশের রাজনীতির মূল নেতৃত্বে নারী, সেই দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নির্যাতন বাড়তে থাকা এবং অপরাধের বিচারহীনতার ব্যাখ্যা কী?

সর্বসাম্প্রতিক বিতর্কে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সমাবেশের বাইরে ঢাকার রাস্তায় কোথায় কী হয়েছে, এটা আমাদের দলের বিষয় নয়। আর এটাতে অবশ্যই সরকারের দায় আছে।’ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির সময়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের অপরাধের দায় দলের নয়, এমন তত্ত্ব হাজির করার সময় তাঁকে কেউ স্মরণ করিয়ে দিলে ভালো হতো যে ওই যুক্তি সঠিক হলে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় সংঘটিত অগ্নিসংযোগ ও মৃত্যুর জন্য তাদেরও দায়ী করা চলে না। তিনি সরকার ও দলের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেছেন, যে ফারাকটি তাঁরা অনেক আগেই মিলিয়ে ফেলেছেন। প্রশাসন ও পুলিশে যে মাত্রায় দলীয়করণ ঘটেছে, তাতে সরকারের আলাদা দলনিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করার অবকাশ কোথায়?

দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকের সামরিক শাসনের অবসানের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রার সূচনায় নব্বইয়ের দশকে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা এবং ধারাটি ছিল বেশ চাঙা। সেই সময়ে দিনাজপুরে হতভাগ্য কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সারা দেশে যে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ডাক উঠেছিল, দেশের নারী অধিকার আন্দোলনে তা একটি গৌরবময় অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে।

পরিস্থিতি এখন অবশ্য অনেকটাই আলাদা। একদিকে কার্যকর বিরোধী দলহীন সংসদ, অন্যদিকে রাজপথের বিরোধিতা দমনের পুলিশি দাপটে গণতন্ত্রের হাল নাজুক। সমাজে প্রতিবাদ যতটুকু আছে, তা মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ঘরোয়া আড্ডা অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিবাদ রাজপথে নেমে আসার নজির যে একেবারে নেই, তা কিন্তু নয়। বিশ্বজুড়ে নারীবাদীরা এখন যে আন্দোলনে নেমেছেন, তার শুরু এবং প্রসার কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরেই।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক