বকশিশের পাশাপাশি হিসাবের পাওনা দিন

কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীরা
কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীরা

সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রাধিকার কোটার শূন্য পদ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। আগেও ক্ষেত্রভেদে মাঝেমধ্যে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হতো। কখনো শূন্যই পড়ে থাকত পদগুলো। স্বাধীনতার পর কোটাব্যবস্থা যখন চালু করা হয়, তখন প্রাধিকারধারী প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদ শূন্য রাখার বিধান ছিল না। আপনা থেকেই নিয়োগকর্তারা সেই মর্মে সিদ্ধান্ত নিতেন। এই নির্দয় সিদ্ধান্তটি পরে নেওয়া হয়েছে। সরকারের পদ শূন্য পড়ে থাকবে। বঞ্চিত হবে সেবাগ্রহীতারা। অথচ মেধাতালিকায় থেকে যেত যোগ্য প্রার্থীরা।

বর্তমান সিদ্ধান্তটি এসেছে জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ পদে নিয়োগকে কেন্দ্র করে। যতটুকু জানা যায়, এ দুটি পদে নিয়োগ পাবে প্রায় ৪ হাজার ৬০০ জন প্রার্থী। এসব পদের জন্য কোটাধারী প্রার্থী তেমন পাওয়া যাবে না, এটা সহজেই অনুমেয়। তাই পদগুলো শূন্য ফেলে না রেখে পূরণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেকোনো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রাধিকার কোটাধারী কোনো প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে তা পূরণ করা হবে। তবে এটা যে কোটাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু কিছুটা সুফল দেবে। বিশেষ করে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদের ন্যায় বিশেষায়িত পদগুলোতে প্রাধিকার কোটাধারী এতসংখ্যক প্রার্থী সব স্তর অতিক্রম করে আসতে পারে না। পারে না সরকারি কলেজগুলোর অনেক বিভাগের শিক্ষক পদেও। তাই মূল সমস্যার ঈপ্সিত সমাধান করতে না পারলেও সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক অবদান রাখবে।

সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা দীর্ঘদিনের অনুসৃত একটি ভ্রান্ত পথ থেকে সরলেন। তাঁদের উপলব্ধি দেরিতে হলেও ভালো দিকে মোড় নিয়েছে, এটা বলতেই হবে। তবে সমস্যার ব্যাপকতার তুলনায় এটার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। মনে হচ্ছে কিছু বকশিশই দেওয়া হলো। হিসাবের পাওনা নিয়ে কিছুই হলো না।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণব্যবস্থাটি দেশের সাম্প্রতিক সময়ে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের একটি। অনেক বিশ্লেষক তাঁদের বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই ব্যবস্থার কুফল বিভিন্নভাবে তুলে ধরছেন। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি অস্থিরতাও লক্ষণীয়। যাঁরা শিগগিরই চাকরির বাজারে আসবেন, তাঁরাই সবচেয়ে বিচলিত ও উৎকণ্ঠিত। প্রাধিকার কোটাধারী সতীর্থর চেয়ে ভালো ছাত্র হয়ে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করেও না-ও পেতে পারেন একই মাপের চাকরি। আর কেউ কেউ চাকরিই পাবেন না। তাই তাঁদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত হওয়া অসংগত নয়। সুতরাং এই ব্যবস্থাকে ন্যায়ভিত্তিক করার দাবি যৌক্তিক।

তাঁদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় কিছু ফল দিতে শুরু করেছে। দেশের গুণীজনদের প্রায় সবাই এ বিষয়ে বলছেন। গণমাধ্যমও জোরদারভাবে তুলে ধরছে সমস্যাটি। দেরিতে হলেও নীতিনির্ধারকদের এটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তাঁদের প্রতিশ্রুত মেধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের পথে সরকারকে যেতে হবে। সেই পথে যেতে কিছু বাধাবিপত্তি থাকবেই। যারা এগুলোর সুবিধাভোগী তারা তা অব্যাহত রাখতে চাইবে, এটাও স্বাভাবিক।

সব দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করে সরকার নেবে সিদ্ধান্ত। যেমনটি নেওয়া হলো গত মন্ত্রিসভার বৈঠকে। এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কোনো শ্রেণির উপকারভোগী জনসংখ্যার অনুপাত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন রয়েছে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের সামগ্রিক স্বার্থকে সর্বোচ্চে স্থান দেওয়া। স্বাধীনতার চেতনা অনুসারে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সংরক্ষণ শুধু সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি বা অঞ্চলের জন্য, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদকে হেলাফেলা করা অনুচিত হবে।

জনপ্রশাসন আজ মেধাশূন্যতায় ধুঁকছে। দীর্ঘদিন ধরে যদি এখানে মেধাবীদের প্রবেশাধিকারকে সংকুচিত করে রাখা হয়, তাহলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তাই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দর-কষাকষিতে আমরা ঈপ্সিত সাফল্য অর্জন করতে পারছি না। যুগের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশাসনে নতুন গতিও তেমনভাবে আসেনি। জনগণ ঈপ্সিত সেবা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। মেধার বিকল্প কোনো ক্ষেত্রেই নেই, এটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সরকারের লক্ষ্য হওয়া সংগত সমাজের সবচেয়ে মেধাবীদের এদিকে আকর্ষণের চেষ্টা করা। তা না করে বরং আমরা এখনো হাঁটছি বিপরীত দিকে।

এটা অনস্বীকার্য, সমাজের অনগ্রসর অংশকে শাসনব্যবস্থার মূল স্রোতোধারায় আনতে মেধাকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। এরূপ অতীতেও হয়েছে। তবে এর আকৃতি ও প্রকৃতি এমনটা ছিল না। অতি সম্প্রতি যে ছাড়টুকু দেওয়া হলো, এর সুফল পাবে বিশেষায়িত ক্যাডারের কিছুসংখ্যক প্রার্থী। সাধারণ ক্যাডারের যেমন-প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, কর, শুল্ক, হিসাব, নিরীক্ষাসহ অন্যান্য ক্যাডারের প্রার্থীরা এর সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

কেননা, এগুলোতে চাকরির সংখ্যা অনেক কম। আর এখানে প্রাধিকার কোটাধারীরা কোনোমতে পাস করতে পারলেই ভালো একটি চাকরি পেয়ে যায়। এমনটাই অতীতের অনেক পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে। তেমনি মেধাতালিকায় ওপরের দিকে থেকেও সেই মানের চাকরি পায়নি বা শূন্য হাতে ফিরে যেতে হয় অনেককে। এখন সম্মিলিত মেধাতালিকাও প্রকাশ করা হয় না। কয়েক বছর আগেও তা হতো। এমনকি বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তদের কারা মেধাতালিকা বা প্রাধিকার কোটা থেকে স্থান পেল, এর কোনো উল্লেখ থাকে না। সুতরাং এই বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার প্রয়োগও করা হয় অস্বচ্ছভাবে।

আর একটি বিষয় আমাদের এখানে এ-বিষয়ক আলোচনায় উপেক্ষিত থাকছে। প্রাধিকার কোটার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলকে অন্যদের সঙ্গে সমান পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য এটি একটি বিশেষ সুযোগ। অনেক জাত-পাতের দেশ ভারতে এ নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। সেখানেও এখন নিয়ম হয়েছে, অনগ্রসর শ্রেণির কোনো প্রার্থী পিতা কিংবা মাতা দ্বিতীয় শ্রেণি বা এর ওপরের সরকারি বা অনুরূপ বেসরকারি চাকরি করলে কিংবা একটি নির্ধারিত পরিমাণ বার্ষিক আয় হলে সেই প্রার্থী কোটা সুবিধা পাবে না। আর কেউ সেই সুবিধার আওতায় চাকরি পেলে তার পরবর্তী প্রজন্ম তা পাবে না। নারী, প্রতিবন্ধী বা জেলা কোটা ছাড়া অন্য কোটাগুলোর জন্য আমরা এই নিয়ম কি করতে পারি না? জেলা কোটার বিভক্তি এখানে একটি জটিল অবস্থানে রয়েছে। সরকারের তথ্যানুসারে, আর্থসামাজিক বিবেচনায় অনগ্রসর কিছু জেলার জন্য একটি থোক কোটা রেখে অন্য জেলাগুলোকে এর আওতা থেকে বাদ দেওয়া সংগত।

ছোট একটি দেশে ১৬ কোটি মানুষ। গুটি কয় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে বাদ দিলে সবার ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরনধারণ একই। এখানে এই তীব্র বিভাজনের মানসিকতা কোনো উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমনিতেই উঁচু মানের ছাত্ররা এখন বিদেশমুখী। ক্রমে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে এটি অস্বাভাবিকও নয়। যেখানে উন্নত জীবনের হাতছানি পাবে, সেদিকেই ছুটবে তারুণ্য। কিন্তু সবাই তো বিদেশে যেতে পারে না। আমাদের বাকি সবাইকে তো এখানেই থাকতে হবে। এখানেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে সব ক্ষেত্রে। এগুলোকে ধরে রাখা এবং আরও গতিশীল করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো। তা করতে হলে জনপ্রশাসনে মেধার দৈন্য দূর করতে হবে। এরূপ করার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নিয়োগ স্তরে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া। সেই অনুপাত কত হবে তা নিয়ে মতান্তর আছে।

তবে মেধা কোটাকেই যে প্রাধান্য দিতে হবে, তাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যেসব ক্ষেত্রে প্রাধিকার কোটাধারী প্রার্থী পাওয়া যাবে না, সেখানে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োপযোগী। পাশাপাশি একই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে কোটাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]