মোদির জন্য অশনিসংকেত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রয়টার্স ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রয়টার্স ফাইল ছবি

ত্রিপুরা জয়ের পর বিজেপি উড়ছিল। উত্তর প্রদেশ ও বিহারের উপনির্বাচন সেই বিজেপিকে মাটিতে আছড়ে ফেলল।

এই দুই রাজ্য, যেখানে না জিতলে ভারত শাসন করা কঠিন, লোকসভায় যে দুই রাজ্যের মিলিত আসনের সংখ্যা ১২০, সেখানে লোকসভার তিনটি আসনের উপনির্বাচনে বিজেপির হার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে অবশ্যই অশনিসংকেত। বিজেপির বলিরেখা আরও গভীর হয়েছে উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরের ফলে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের এই খাসতালুক, অনন্তকাল ধরে যা বিজেপির দুর্গ বলে পরিচিত, যেখান থেকে আদিত্যনাথ পাঁচ-পাঁচবার লোকসভায় জিতেছেন, সেখানেই সমাজবাদী পার্টির কাছে বিজেপিকে হারতে হলো। এই লজ্জা যতটা আদিত্যনাথের, ততটাই নরেন্দ্র মোদির। কেননা, আগামী বছর দিল্লি শাসনের ছাড়পত্র তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য পাবেন কি না, তা নির্ভর করছে এই উত্তর প্রদেশ ও বিহারের ওপরেই।

মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র গোরক্ষপুর ছাড়াও বিজেপি উত্তর প্রদেশে হারিয়েছে উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যর ফুলপুর কেন্দ্র। বিহারের আরারিয়া লোকসভা কেন্দ্রেও হার হয়েছে তাদের, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) কাছে। এ ছাড়া জাহানাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রও জিতে নিয়েছে আরজেডি। বিজেপি ও সংযুক্ত জনতা দলের লজ্জা ঢাকতে ওড়নার কাজ করেছে শুধু ভাবুয়া বিধানসভা কেন্দ্র, যা বিজেপির কাছে ছিলই।

অখিলেশ যাদব। রয়টার্স ফাইল ছবি
অখিলেশ যাদব। রয়টার্স ফাইল ছবি

এই উপনির্বাচন দুটো বিষয় স্পষ্ট করে দিল। এবারের মতো আগামী দিনে উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) হাতে হাত মেলালে বিজেপির পক্ষে তা মোটেই সুসময় হবে না। দ্বিতীয়ত, জেলে থাকলেও বিহারে লালু প্রসাদের দাম এখনো মরা হাতি লাখ টাকার মতো।

উত্তর প্রদেশে অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর যুগলবন্দী ছিল এই সময়ের সেরা রাজনৈতিক চমক। এই সময়ই বা বলি কী করে? এই দুই দল প্রথম ও শেষবারের মতো হাত ধরাধরি করেছিল সেই ১৯৯৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়। তার ঠিক আগের বছর ধ্বংস হয়েছে বাবরি মসজিদ। উত্তর প্রদেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছিল গেরুয়া লহর। মায়াবতীকে সঙ্গে নিয়ে কাঁসিরাম সেই সময় গিয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদবের কাছে। জোট বেঁধে ভোটে লড়ে বিজেপির রথ রুখে দিয়েছিলেন তাঁরা। তার দুই বছর পর থেকে সেই যে শত্রুতার শুরু, তা মিত্রতায় রূপ নিল এবার, সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্বে যখন মুলায়ম-পুত্র অখিলেশ, মায়াবতী যাঁর ‘বুয়া’ ও অখিলেশ যাঁর ‘ভাতিজা’। উত্তর প্রদেশজুড়ে এখন একটাই স্লোগান, ‘বুয়া-ভাতিজা জিন্দাবাদ’।

অখিলেশের হাত ধরা ছাড়া মায়াবতীর উপায়ও ছিল না। ২০১২ সালে বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পর ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও তিনি হালে পানি পাননি। ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও দুরমুশ করেছে। একের পর এক ভোটে বিপর্যয়ের পর এই উপনির্বাচনে ভাতিজাকে সমর্থন দিয়ে মায়াবতী বেঁচে থাকার অক্সিজেনের খোঁজ পেতে চেয়েছিলেন। অতীতে পড়ে না থেকে ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে বুয়া-ভাতিজা হাত ধরাধরি করে বাঁচতে চেয়েছেন। সেই কৌশল বিজেপিকে দাঁড় করিয়েছে চূড়ান্ত বাস্তবতার মুখোমুখি। আসছে বছর উত্তর প্রদেশে এই দুই শক্তি একজোট হলে দিল্লির দরবার মোদি অ্যান্ড কোংয়ের কাছে টলমলে হয়ে যাবে। বুধবার পাঁচ উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মোদি-শাহ জুটি তাই ‘স্পিকটি নট’।

লালু প্রসাদ যাদব। রয়টার্স ফাইল ছবি
লালু প্রসাদ যাদব। রয়টার্স ফাইল ছবি

নিজের ক্ষমতা নিয়ে ভাবার সময় কিন্তু বিজেপির এসে গেছে। ২০১৪ সালের ভোটের পর তাদের কাছে ছিল লোকসভার ২৮২ আসন। এখন তা কমে ২৭৩-এ দাঁড়িয়েছে। সেই থেকে হিমাচল প্রদেশের স্থানীয় স্বশাসিত ভোটে তাদের ফল খারাপ হয়েছে। গুজরাটে কানের পাশ দিয়ে তির বেরিয়ে গেছে। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের উপনির্বাচনে গোহারা হেরেছে। এবার হারতে হলো উত্তর প্রদেশ ও বিহারে। তাদের ভাবা দরকার, যেখানে ক্ষমতায় নেই, সেখানে কেন জিতছে, কেনই-বা হারছে ক্ষমতায় থাকা রাজ্যে? ত্রিপুরায় বাম শাসনের অবসান তারা ঘটাল। ক্ষমতায় এল মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে। ওডিশার পঞ্চায়েত ভোটেও কংগ্রেসকে সরিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল। তবে কি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে মোদি-ম্যাজিক সেভাবে কাজ করছে না? প্রশাসক হিসেবে তাঁর যাবতীয় কারিকুরি ধরা পড়ে যাচ্ছে?

এই আত্মবিশ্লেষণের পাশাপাশি মোদি-শাহ জুটিকে আগামী দিনে করতে হবে অন্য একাধিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা। তাঁদের প্রধান চ্যালেঞ্জ সম্ভাব্য বিরোধী জোট। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ইতিমধ্যেই সে বিষয়ে সক্রিয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বিরোধী জোটের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে বিরোধী নেতাদের মধ্যে বিরোধ আছে। রাহুলকে জোটের নেতা মানতে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি প্রবল। অনীহা শরদ পাওয়ারেরও। এ জন্য তাঁরা নিজেদের মতো করে সক্রিয়। তবে এটাও ঠিক, কংগ্রেস ছাড়া বিরোধী জোটের অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা কংগ্রেস ছাড়া আর কারও নেই। সোনিয়া তাই নৈশভোজের মাধ্যমে সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে আনতে সচেষ্ট। মমতা ও শরদ পাওয়ার তাঁদের মতো করে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন ঠিকই। রাজনীতিতে এটাই দস্তুর। স্বস্তির বিষয় একটাই, এই উপনির্বাচন বুঝিয়েছে, জোট ছাড়া মোদির বিজেপিকে রোখা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও।

মায়াবতী। রয়টার্স ফাইল ছবি
মায়াবতী। রয়টার্স ফাইল ছবি

বিরোধীদের কাছে যা স্বস্তিদায়ক, বিজেপির কাছে তা ততটাই দুশ্চিন্তার। গোটা ভারত অদ্ভুতভাবে গ্রাম ও শহরে ভাগাভাগি হয়ে গেছে। গুজরাটের শহর মুখ না তুললে বিজেপি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারত না। গ্রামকে গ্রাম তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। স্মরণাতীতকালে যা দেখা যায়নি, মহারাষ্ট্রের কৃষকদের ‘লং মার্চ’ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের ক্ষোভ মাথাচাড়া দিচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে অঙ্গীকার মোদিকে ক্ষমতাসীন করেছে, সেই দুর্নীতিই আজ তাঁকে দাঁড় করিয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও তার খলনায়কদের একের পর এক দেশত্যাগ যে প্রশ্ন তুলেছে, তার কোনো সদুত্তর প্রধানমন্ত্রী আজও দিতে পারেননি। শান্তিপূর্ণ ‘লং মার্চ’ মুম্বাই পৌঁছানোর পর কৃষকদের খুশি করতে ঋণ মওকুফের যে প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ দিয়েছেন, তা অবশ্যই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের চিন্তিত রাখবে। মোদি-সরকারকে কংগ্রেস অনেক দিন থেকেই ‘সুট-বুটের সরকার’ বলে চিহ্নিত করেছে। শিল্পবান্ধব ও কৃষিবিরোধী সরকারের তকমা দিয়েছে। এর মোকাবিলা নরেন্দ্র মোদি কীভাবে করবেন, তা এখনো অজানা। তিনি বিলক্ষণ জানেন, ভারত গ্রামেই বসবাস করে এবং গ্রামকে অখুশি রেখে ভোটে জেতা যায় না।

উত্তর প্রদেশ একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে। উড়ন্ত বিজেপিকে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ উপন্যাসের মুখবন্ধ এটা। পরবর্তী অধ্যায়গুলো লেখার দায়িত্ব ‘বুয়া-ভাতিজা’র।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি