রদবদলে কী বার্তা পাওয়া গেল?

বরখাস্ত হওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
বরখাস্ত হওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনে অদলবদল কোনো বিস্ময়কর বিষয় নয়। গত ১৪ মাসের কিছু বেশি সময়ে প্রশাসন এবং তার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কমপক্ষে ২৩ জন হয় পদত্যাগ করেছেন বা পদচ্যুত হয়েছেন। গত দুই সপ্তাহেই গেছেন পাঁচজন। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবার সকালে টিলারসনকে তাঁর প্রশাসন থেকে এককথায় বিদায় দিয়েছেন, প্রচলিত বাংলায় যাকে বলে পত্রপাঠ বিদায়। একসময় টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো ‘অ্যাপ্রেনটিস’-এ ট্রাম্প যেভাবে ‘ইউ আর ফায়ার্ড’ বলে অংশগ্রহণকারীদের বিদায় দিতেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তা-ই করছেন। এই পদচ্যুতি এবং এর সঙ্গে অন্য যেসব পরিবর্তন ঘটল, তাতে কী বার্তা আছে?

রেক্স টিলারসনের বিদায় খুব অপ্রত্যাশিত বিষয় ছিল না। গত বছরের নভেম্বরেই জানা গিয়েছিল যে টিলারসনের বিদায় সময়ের ব্যাপার মাত্র। নিউইয়র্ক টাইমস-এ ৩০ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও টিলারসনের সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছে যে তাঁকে কী করে বিদায় করা যায়, হোয়াইট হাউস সেই পথ খুঁজছে। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল যে টিলারসনের বদলে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ডিরেক্টর মাইক পম্পিয়োকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করাই হচ্ছে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হলে ১ ডিসেম্বর ট্রাম্প টুইট করেছিলেন ‘ফেইক নিউজ’ বলে। মঙ্গলবার সকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইটে আমরা সেই খবর যে সত্য ছিল, তা জানতে পারলাম।

বলা বাহুল্য যে ট্রাম্প প্রশাসনের নিয়োগ, পদচ্যুতি বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সবই জানা যায় প্রেসিডেন্টের টুইটে; গত বছরের ২০ জানুয়ারির আগে ছিল অকল্পনীয় যে সরকারি সিদ্ধান্ত এভাবে জানা যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যাঁরা পদচ্যুত হন, তাঁরাও নিজেদের এই বিদায়বার্তা জানতে পারেন টুইটে কিংবা গণমাধ্যমের খবরে, যা কোনো অবস্থায়ই সম্মানজনকভাবে বিদায় বলা যাবে না। গত বছরের ৯ মে এফবিআইয়ের প্রধান জেমস কমি তাঁর পদচ্যুতির খবর পেয়েছিলেন সিএনএনের খবরে ক্যালিফোর্নিয়ায় এফবিআইয়ের অফিসে বৈঠক করার সময়। টিলারসন তাঁর পদচ্যুতি সম্পর্কে কখন জেনেছেন, সে বিষয়ে এখন হোয়াইট হাউসের বক্তব্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যে বেশ গরমিল দেখা দিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বেশ কিছু গণমাধ্যমে বলা হচ্ছিল, টিলারসনকে ৯ মার্চ শুক্রবার রাতেই জানানো হয়েছে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু টিলারসনের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ফর পাবলিক ডিপ্লোমেসি স্টিভ গোল্ডস্টেইন এই ভাষ্যের বিরোধিতা করে বলেন যে টিলারসনের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সম্প্রতি কথা হয়নি এবং টিলারসন জানেন না কেন তাঁকে পদচ্যুত করা হয়েছে। (এই বক্তব্যের পর গোল্ডস্টেইনকেও বিদায় করে দেওয়া হয়েছে।) পরে হোয়াইট হাউস বলে যে প্রেসিডেন্ট নন, চিফ অব স্টাফ কেলি ফোন করে জানান যে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে কখন তা হবে, তা তাঁকে জানানো হয়নি। এ বিষয় নিয়ে বিতর্কের কারণ হচ্ছে, কেন টিলারসনকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বলছেন যে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে এবং বেশ কিছু বাণিজ্য চুক্তিবিষয়ক আলোচনার প্রস্তুতির জন্য এই পদক্ষেপ। পরে প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁর সঙ্গে টিলারসনের মতপার্থক্যের বিষয়, বিশেষ করে ইরান চুক্তি বিষয়ে পার্থক্য স্বীকার করেছেন।

কিন্তু আসলে ঘটনাপ্রবাহে সুস্পষ্ট যে এর পেছনে কাজ করছে রাশিয়া বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টিলারসনের মতপার্থক্য। সোমবার ১২ মার্চ টিলারসন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন যে ব্রিটেনে একজন সাবেক রুশ গুপ্তচরকে হত্যায় নার্ভ গ্যাস ব্যবহারের সঙ্গে রাশিয়া যুক্ত। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠতা এবং গত নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের যে কালো ছায়া এই প্রশাসনের ওপর বিস্তার করে আছে, তার সর্বশেষ শিকার হলেন টিলারসন। এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে প্রেসিডেন্ট রাশিয়া প্রশ্নে কতটা স্পর্শকাতর।

তবে এটা ঠিক যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টিলারসনের মতপার্থক্য এমনই ছিল যে অতীতে খবর বেরিয়েছিল, তিনি গত বছরের জুলাই মাসে এক বৈঠকে ট্রাম্পকে ‘মূর্খ, গবেট’ বলে মন্তব্য করেছেন। সেই সময় থেকেই তাঁর পদত্যাগের বা পদচ্যুতির কথা বলা হচ্ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে টিলারসন কেবল যে ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্প সময় ছিলেন তা-ই নয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সাফল্য একেবারেই নেই। তাঁর সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শীর্ষ পর্যায়ের ৬০ শতাংশ কূটনীতিকসহ কয়েক শ ব্যক্তি চলে গেছেন। ফলে অনেকের ধারণা যে তাঁর সময়ে এই দপ্তরের যত ক্ষতি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হবে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে টিলারসন প্রচলিত অর্থে যাকে এস্টাবলিশমেন্ট বলা হয়, সেই ধরনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, ফলে ট্রাম্পের ইম্পালসিভ বা হুজুগে ধরনের নীতির বিপরীতে একটা বাধা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ঠিক এ কারণেই তাঁর পরিবর্তে কাকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা পৃথিবীর জন্য বিবেচনার বিষয়।

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যে নিয়োগ সিনেটে অনুমোদিত হতে হবে, তিনি হচ্ছেন মাইক পম্পেও। পম্পেও এমন এক ব্যক্তি, যাঁর অবস্থান অনেক বিষয়েই ট্রাম্পের কাছাকাছি এবং অনেক বিষয়ে তিনি কঠোর অবস্থানের পক্ষে। যেমন ইরানের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রবিষয়ক চুক্তি। তিনি এই চুক্তির ঘোর বিরোধী। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ঈর্ষণীয়। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি কট্টর দক্ষিণপন্থী, রিপাবলিকান দলের দক্ষিণপন্থী টি পার্টির হয়েই তিনি সিনেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সিনেটে বেনগাজিবিষয়ক তদন্তের সময় হিলারি ক্লিনটনের কাছে তাঁর প্রশ্নগুলো প্রমাণ করে যে তিনি স্থিতধী পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী নন। মাইক পম্পেওর এই অবস্থান নিঃসন্দেহে সারা পৃথিবীর জন্য একটি বার্তা। ফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আরও বেশি ট্রাম্পের স্বাক্ষর দেখতে পাব এবং সেই লক্ষ্যে আরও বেশি কঠোর ও কট্টর পন্থা দেখতে পেলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।

এই পরিবর্তনের আরেকটি দিক হচ্ছে সিআইএর প্রধান পদে জিনা হ্যাসপেলের নিয়োগ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মনোনয়ন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই প্রথমবারের মতো কোনো নারী সিআইএর প্রধান হচ্ছেন। নারীদের ব্যাপারে ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসনের নেতিবাচক রেকর্ডের প্রেক্ষাপটে তিনি এই ঘোষণা থেকে যে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছেন, তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু যাঁরা জিনা হ্যাসপেলের অতীত জানেন, তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে যে তিনি বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালানোর যে কার্যক্রম, তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০২ সালে হ্যাসপেল দায়িত্বে ছিলেন থাইল্যান্ডে এমন গোপন বন্দিশালার, যেখানে দুজন বন্দীকে নির্যাতন করা হয়েছে এবং ২০০৫ সালে সেই সব ভিডিও ধ্বংস করে ফেলার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে।

ইতিমধ্যে এই দাবি উঠেছে যে সিনেটে তাঁর নিয়োগ অনুমোদন শুনানির আগেই বন্দী নির্যাতনের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতাবিষয়ক তথ্যাদি অবমুক্ত করা হোক। যদিও জিনা হ্যাসপেল সিআইএর ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন, ডিরেক্টর হিসেবে তাঁর মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা ছিল না, ফলে এই মনোনয়নকে কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনার উপায় নেই। এর মধ্যে যে বার্তা, তা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং বিশ্বে কারও জন্যই ইতিবাচক নয়। নাগরিকেরা কোনো অবস্থাতেই চাইবেন না সেই সময়ে ফিরে যেতে, যাকে সিনেটের জন ম্যাককেইন বর্ণনা করেন, ‘আমেরিকার ইতিহাসের কালো অধ্যায়গুলোর একটি অধ্যায়’ বলে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর