ফুল ধরেছে মৃত্যুগাছে

সানজিদা, রফিক ও অনিরুদ্ধ পরিবার
সানজিদা, রফিক ও অনিরুদ্ধ পরিবার

সানজিদা হক, রফিক জামান আর অনিরুদ্ধর এই ছবিটার দিকে তাকাই। একটা পরিবার ছিল। তাঁদের সংসার ছিল। সানজিদা কাজ করতেন হাঙ্গার প্রজেক্টে। লাল টিপ দিতে পছন্দ করতেন। অফিসের কম্পিউটারে এখনো লাগানো আছে একটা লাল টিপ। রফিক জামান প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতেন। তিনি ছাত্ররাজনীতি করতেন। ঢাকা কলেজে ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। তাঁদের সন্তান অনিরুদ্ধ পড়ত অরণি বিদ্যালয়ে। কত আনন্দ নিয়ে তাঁরা নেপালে যাচ্ছিলেন। টিকিট কাটা, ছুটি জোগাড় করা, কম উত্তেজনা, কম পেরেশানি! এই রকম একটা পরিবার এক মুহূর্তে নেই হয়ে গেল। মুছে গেল দুনিয়া থেকে?

জীবনের মানে কী?

পিয়াস রায় ছিলেন প্রথম আলো বন্ধুসভা গোপালগঞ্জের সদস্য। বরিশালের ছেলে। গোপালগঞ্জের মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষে পড়তেন। কদিন পরেই তাঁর ডাক্তার হওয়ার কথা। ২০১৬ সালে বন্ধুসভার জাতীয় সম্মেলনে এসেছিলেন তিনি। মঞ্চে তাঁর ছবিও আছে। ১২ মার্চ কাঠমান্ডুগামী ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে তিনিও ছিলেন। এ রকম একটা হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলে আর ফিরবে না ক্যাম্পাসে, ফিরবে না স্বজনদের কাছে।

৫১ তো সংখ্যা নয়। ৫১ জন মানুষ। তাঁদের প্রত্যেকের আছে জন্মের ইতিহাস, প্রথম হাসা, প্রথম কাঁদা, প্রথম কথা বলা, প্রথম হাঁটা। স্কুলে যাওয়া, পরীক্ষার আগের রাতের উদ্বেগ, ফল পাওয়ার পরের প্রতিক্রিয়া, আছেন বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, দূরের বন্ধু, কাছের বন্ধু। আমরা সইতে পারি না। তাঁদের জন্য বুকটা ভেঙে আসে, হৃদয় বিদীর্ণ হয়। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদেরও কত কষ্ট করতে হচ্ছে, কেউবা স্বজন হারিয়েছেন, কেউবা অগ্নিদগ্ধ হয়ে যন্ত্রণা সইছেন। আরও একটা ভাবনা চলে আসে। ওই ফ্লাইটে আমিও থাকতে পারতাম।

আমরা অবশ্যই চাইব আমাদের আকাশপথ নিরাপদ হোক। নিরাপত্তাই প্রথম। এই কথাটা যেন আমরা সব সময় সর্বক্ষেত্রে মনে রাখি। বিমান চালনার বা পরিচালনার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কতগুলো নিয়মকানুন আছে। ম্যানুয়াল আছে। সেসব যেন মানা হয়। ইউএস-বাংলার এই দুর্ঘটনার পর নানা কথা শোনা যাচ্ছে। আমরা শুধু বলব, তদন্ত করা হোক, কোথায় ত্রুটি হলো তা শনাক্ত করা হোক, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক, আর এ ধরনের দুর্ঘটনা যেন আর একটাও না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো বিমান চালনার ব্যাপারে স্বীকৃত নিয়ম মানে না-এ ধরনের অভিযোগ শুনতে পাই। আবহাওয়ার রাডার না থাকা, যাওয়া-আসার অতিরিক্ত যে পরিমাণ তেল নিয়ে উড়তে হয়, তা না নিয়েই উড়াল দেওয়া-এ ধরনের কথা আমাদের বন্ধু-পাইলটেরা আমাদের বলেছেন। মৌখিক আড্ডার অভিযোগ হলেও অভিযোগ যেহেতু গুরুতর, তাই এখানে পেশ করে রাখলাম। আশা করি, নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো বিমান যেন একটুখানি ছাড়ও না দেয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারি মনিটরিং বাড়ানো হবে।

বিমান দুর্ঘটনার খবরের আগের খবর ছিল, মিঠাপুকুর যেন মৃত্যুপুরী। ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা গেছে অনেকেই। এরা গরিব মানুষ বলে হয়তো আমাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারে না। কিন্তু কথা কি জানেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শঙ্কা আমাদের সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবীতে বিমান দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে মৃত্যু ৫৯,২০১৬ সালে ২৫৮ আর ২০১৫ সালে ১৮৬,২০১৪ সালে ৬৯১। সূত্র: স্টাটিস্টা ডট কম। এটা সারা দুনিয়ার হিসাব।

আর ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে শুধু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ২৯৭ জন। এটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে বের করা হিসাব। ২০১৬ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬ হাজার ৫৫ জন। ২০১২ পর্যন্ত ১৪ বছরে মারা গেছে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ। এটা রীতিমতো গণহত্যার পর্যায়ে কিংবা মহামারির পর্যায়ে গেছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার আগের ২০ বছরে ৫ হাজার ৫০০ মানুষ মারা গেছে নৌপথে, হারিয়ে গেছে আরও দেড় হাজার। ২০ বছরে ৭ হাজার, মানে গড়ে প্রতিবছর নৌ দুর্ঘটনায় মারা যায় ৩৫০ জন।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যার বিশালতা-আট বছরে ট্রেনের ধাক্কায় বা চাকার নিচে পড়ে মারা গেছে ২ হাজার ৩২১ জন, ২০১৭ সাল পর্যন্ত। মৃত্যু কত সহজ এখানে। আমাদের লেভেল ক্রসিংয়ে কিংবা ট্রেনে কাটা পড়ে যত মানুষ মারা যায়, সারা পৃথিবীতে বিমান দুর্ঘটনায় তত মানুষ মারা যায় না। বিমান এখনো পৃথিবীর নিরাপদতম যান।

বন্ধুসভার পিয়াস রায়
বন্ধুসভার পিয়াস রায়

কিন্তু একটা মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয়, যদি তা সতর্কতার অভাবে, বেখেয়ালে, নিয়মকানুন না মানায়, মনিটরিং না থাকায় সংঘটিত হয়। টাইটানিকও ডুবেছিল, কিন্তু পৃথিবীর আর কোথাও তো এত লঞ্চডুবির খবর পাই না। এত বড় বড় সামুদ্রিক ঝড় আসে, খুব কমই তো জাহাজডুবির কথা শুনি। তাহলে বাংলাদেশে এত লঞ্চ ডোবে কেন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া, সিগন্যাল না মানা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নকশায় ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন নৌযান চালানো, অদক্ষ চালক-নানা কারণে নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কপথে প্রতিদিন গড়ে ১৬ জন মারা যায় এ দেশে। সে হিসাবে ১২ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ ৬৪ জন মারা গেছে সারা দেশে, সড়ক দুর্ঘটনায়, যা কাঠমান্ডু ট্র্যাজেডির চেয়েও ভয়াবহ।

প্রথম আলো লিখেই চলেছে, সড়কপথে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। বকা মিয়া বকে যাচ্ছে, শোনা মিয়া শুনছে না। বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো, মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলো। আমরা মেনেই নিয়েছি, সড়কপথে আমরা মানুষ মারতেই থাকব। শুধু কি মৃত্যু? আহত পঙ্গু মানুষগুলোর পরিবারের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভোগের বিভীষিকা।

তাহলে করণীয় কী?

আবারও বলি, করণীয় কী, তা স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর বা স্বীকৃত প্রক্রিয়া ম্যানুয়ালে বা নির্দেশিকায় লেখা আছে। সেগুলো মানতে হবে। সড়কপথকে দুর্ঘটনামুক্ত করতে হলে কী কী করতে হবে, তা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, বহু গবেষণা আছে, বহু সুপারিশপত্র আছে। এখন দরকার সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা, প্রক্রিয়াগুলো মান্য করা। কেউ তা করবে না। ফলে আমরা আমাদের সড়কপথে নদীপথে আকাশপথে মানুষ মারতেই থাকব। আমাদের স্বজনেরা মারা গেলে আমরা কাঁদব, হইচই করব, ক্ষুব্ধ হব। আমি মারা গেলে আমার স্বজনেরা বা সহকর্মীরা কাঁদবেন, প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু এই মহামারি চলতেই থাকবে।

কেন? কারণ সুশাসন নেই, জবাবদিহি নেই। বিআরটিএতে দুর্নীতি হয়, এটা সবাই জানে। আমাদের চালকদের অনেকেই প্রশিক্ষিত নন, এটাও আপনি-আমি জানি। ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চলে, জানা কথা। বাস-ট্রাকের চালকেরা অতিরিক্ত ডিউটি করেন, জানা কথা। দুই দিন না ঘুমিয়ে স্টিয়ারিং হাতে যদি তাঁরা ঘুমিয়ে না পড়েন, তাহলেই তো তা হবে বিস্ময়কর ব্যাপার।

আবার আমাদের মহাসড়ক বা হাইওয়েগুলো মোটেও হাইওয়ে নয়। এটাতে গরুও চলে, রিকশাও চলে, হাট বসে, দুই ধারে দোকানপাট। তিন লেনের মহাসড়কে যখনই ওভারটেক করা হয়, তখনই মুখোমুখি সংঘর্ষের শঙ্কা থাকে, বাকিটা আল্লাহর হাতে। আমরা এইভাবে চলছি। সুযোগ পেলে নিয়ম ভঙ্গ করতে আমরা কেউই ছাড়ি না। এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ। আর তা ঘটতে পারে, যখন সিস্টেম বা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়।

সর্ব অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা। আমরা বলব, মাথা থেকেই ওষুধ দেওয়া শুরু করতে হবে। ওপর থেকেই শুরু করুন। সিস্টেম বা ব্যবস্থাটা ঠিক করুন।

জয় গোস্বামীর একটা কবিতা আছে—এই মালঞ্চ নিয়তিময় ফুল ধরেছে মৃত্যুগাছে, বাইরে যাওয়ার রাস্তা কোথায় শুধাও না ঝাউ পাতার কাছে। ঝাউগাছের পাতার কাছে শুধোলে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। সমাধান তাদেরই বের করতে হবে, যাদের ওপর ভার দেওয়া হয়েছে। তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শক্তি...

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক