কিম-ট্রাম্প বৈঠক কি শেষ পর্যন্ত হবে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উন
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উন

গত বছর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে অন্যের দিকে শিশুতোষ অপমানসূচক বক্তব্য ছোড়াছুড়ি করেছিলেন। কিম সম্পর্কে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘রকেটম্যান এখন আত্মঘাতী মিশনে আছেন।’ অন্যদিকে কিম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত মার্কিন বৃদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। একই সঙ্গে পূর্ব এশিয়াকে ‘আণবিক হামলা-পরবর্তী পতিতভূমি’তে পরিণত করার হুমকি দিয়েছিলেন কিম।

হঠাৎ করে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিয়েছে, এই দুজন মে মাস নাগাদ বৈঠকে মিলিত হতে রাজি হয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কিম জং-উন পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এবং ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছেন। ট্রাম্পও বৈঠকে বসতে রাজি হয়েছেন। তবে ঘটনার উল্টো দিকে মোড় নেওয়াকে অবশ্যই সতর্কতা ও বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। নরক থেকে আসা এক সমস্যার নাম উত্তর কোরিয়া। না দক্ষিণ কোরিয়া, না যুক্তরাষ্ট্র-কোনো পক্ষই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে সাফল্য এবং ব্যর্থতার সংজ্ঞা খুবই আপেক্ষিক এবং ট্রাম্পকে অবশ্যই পিছু না হটার কৌশল মাথায় নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।

এ পর্যন্ত যত ঘোষণা এসেছে, তার সবই এসেছে সিউল থেকে। পিয়ংইয়ং কিংবা ওয়াশিংটন থেকে নয়। উত্তর কোরিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে আসা দম্পতির ছেলে মুন জায়ে-ইন দুটি প্রতিশ্রুতির ওপর ভর করে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। একটি হলো অবরোধ, অপরটি কূটনীতি। শীতকালীন অলিম্পিকে দুই কোরিয়ার এক দল হিসেবে অংশগ্রহণ তারই ফলাফল। দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাং শহরে অনুষ্ঠিত এই অলিম্পিকে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিমের বোন কিম ইয়ো জং। এর পরপরই মুনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা চু ইউ ইয়োং এবং গোয়েন্দা প্রধান সুহ্ হুন পিয়ংইয়ং ও ওয়াশিংটনে সফর করেন। ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের লনে চু ইউ ইয়োংয়ের পাশে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত দাঁড়িয়ে তাঁদের বৈঠকের ঘোষণা দেন। যদিও এ সময় সেখানে কোনো মার্কিন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না।

উত্তর কোরিয়া এ পর্যন্ত ছয়বার পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছে। তাদের পরমাণু কার্যক্রমের অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা আছে। কোনটা বাতিল করতে হবে, কোনটা রাখা যাবে, কোনটা বদলে ফেলতে হবে এবং এসবের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কী সুবিধা দিতে পারবে-এসবই আলোচনার ভিত্তি হতে পারে। উত্তর কোরিয়া তার পরমাণু কার্যক্রমের বিদ্যমান সক্ষমতা স্থগিত করে রাখবে নাকি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে-এই বিষয়টি চুক্তিতে থাকবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর জবাব নির্ভর করছে উত্তর কোরিয়ার বোমা বানানোর মূল উদ্দেশ্য কী তার ওপর।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার হুমকি কিমের মন সামান্যই টলাতে পেরেছে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা পর্যন্ত ট্রাম্পের এই হুমকিকে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেননি। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ওয়ারহেড, বোমা তৈরির কারখানা, বোমা সরবরাহের যানবাহনের অবস্থান শনাক্ত করা এবং সেগুলো ধ্বংস করার ক্ষমতার অভাব যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম থেকেই আছে। পরমাণু বোমার পাশাপাশি উত্তর কোরিয়ার রয়েছে বিশাল দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হামলার হুমকিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় বসবে না বলে ওয়াশিংটন যে অবস্থান নিয়েছিল, সেখান থেকে সরে আসায় এই সম্মেলন হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয়তায় কিম আস্থা রাখবেন না। তাঁর দাবি, যেকোনো চুক্তি হতে গেলে ওই চুক্তিতে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন থাকতে হবে, জাপান ও অন্যদের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা থাকতে হবে, সর্বোপরি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারা ওই চুক্তি অনুমোদিত হতে হবে। চীন ও রাশিয়া ট্রাম্প ও কিমের মুখোমুখি সংলাপের খবরকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে জাপান অস্বস্তিতে আছে।

উত্তর কোরিয়া যে ছয়টি বিষয় চুক্তিতে রাখতে চায় সেগুলো হলো ১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত অস্ত্রবিরতির স্থলে একটি শান্তিচুক্তি প্রতিস্থাপন করতে হবে, উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়া বন্ধ করতে হবে, উত্তর কোরিয়াকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে হবে, উত্তর কোরিয়ার মহাকাশবিষয়ক কার্যক্রম চালাতে দিতে হবে এবং পরমাণু জ্বালানি সহায়তা দিতে হবে। সব পক্ষই জানে ঐকমত্যে পৌঁছানো কঠিন। তবে এ মুহূর্তে আলোচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পিছিয়ে আসা আরও কঠিন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
রমেশ ঠাকুর: অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন অ্যান্ড ডিজআর্মমেন্টের পরিচালক এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব