পুলিশ সদস্যের এ কেমন আচরণ?

শুক্রবার সকালে প্রথম আলোয় যখন খবরটি পড়ছিলাম, তখন হতবাক হয়ে যাই। কোনো পুলিশ সদস্যের পক্ষে এ রকম আচরণ করা সম্ভব? কী রকম মানসিকতা তাঁর? নারীর প্রতি তাঁর এ কেমন মনোভাব?

খবরটি ছিল, সফটওয়্যার প্রকৌশলী তানিয়া আলম তাঁর স্কুটিতে করে সন্তানকে ধানমন্ডির ১১ নম্বর সড়কে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে সাইফুল নামের এক ট্রাফিক পুলিশ অন্য গাড়িচালকদের তানিয়া আলমের স্কুটিতে ধাক্কা দেওয়ার জন্য উসকে দিচ্ছিলেন। সাইফুল বলছিলেন, ‘মারেন ভাই মারেন। একে তো মেয়েমানুষ, তার ওপর স্কুটি চালায়। ডেইলি দুইটা বাচ্চা নিয়া দিতে আসে। মারেন। মারলে কোনো সমস্যা নেই। আমি বলছি মারলে কোনো সমস্যা নেই।’

পুলিশের এ রকম কথায় তানিয়া ও তাঁর সন্তান ভয় পেয়ে যায়। এরপর তানিয়া সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফের ওই পুলিশ সদস্যের কাছে যান। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি ট্রাফিক আইন ভেঙেছেন কি না বা তাঁর কোনো অপরাধ আছে কি না। কোনো উত্তর মেলে না। পরে তিনি পুলিশের ওই সদস্যের একটি ছবি তুলে ৩২ নম্বরে ট্রাফিক ফাঁড়িতে যান। কিন্তু ফাঁড়ির পুলিশেরা তাঁকে কোনো ধরনের সাধারণ ডায়েরি না করার পরামর্শ দেন। সেখানে পুলিশের সহকারী কমিশনার আকরাম হাসান তাঁকে বলেছেন, অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে, পুলিশই তদন্ত করবে।

এই সংবাদটি পড়ে প্রথম মনে প্রশ্ন জাগে, কেমন পুলিশ তারা? তারা কি আসলেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত, নাকি নারীদের হেনস্তা করার মিশনে ব্যস্ত?

পুলিশে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের একমাত্র ব্রতই জনগণের জানমাল রক্ষা করা। আর সাইফুল তার বদলে কী করলেন? যে পুলিশ সদস্যের নারীদের উত্ত্যক্তকারীদের প্রতিহত করার কথা, সেই পুলিশই কিনা উত্ত্যক্তকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তা-ও কিনা সন্তানের সামনে?

আর আকরাম হাসান? পুলিশের সহকারী কমিশনার হয়ে কী করে নিজের দায়িত্বের কথা ভুলে গেলেন? কী করে পারলেন সাইফুলের বিরুদ্ধে কোনো সাধারণ ডায়েরি না করার পরামর্শ দিতে?

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ২০১৫ সালে একটি গবেষণা করে। তাতে দেখা গেছে, যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৪ শতাংশ নারীই থানায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। এর কারণ হিসেবে তাঁরা পুলিশের দ্বারা হেনস্তা হওয়ার কথা বলেছেন। কী দুর্ভাগ্য এ দেশের নারীদের!

খুব জানতে ইচ্ছা করে সাইফুল আর আকরামের মনের কথা। একজন নারীর স্কুটি চালানো কি তাঁরা মেনে নিতে পারেননি? তাই এই বৈরী আচরণ? এভাবে উত্ত্যক্ত করা?

ভাবি এ কেমন দেশে বসবাস আমাদের? এখানে নারীর কোনো নিরাপত্তা নেই। খোদ পুলিশও তাঁদের রেহাই দেয় না। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু এই কথার যে আসলে কোনো ভিত্তি নেই, তানিয়া আলমের সঙ্গে ঘটা ঘটনাই তার একটি প্রমাণ।

হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের (সিএইচআরআই) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরুষ পুলিশ সদস্যদের হাত থেকে রেহাই পান না নারী পুলিশ সদস্যরাও। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ ভাগের বেশি সদস্য কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন। পুলিশ বিভাগে কর্মরত নারী কর্মকর্তাদের (উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক) শতকরা তিন ভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশরাও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বাইরে নন।

প্রশ্ন হচ্ছে, কবে এসবের অবসান হবে? কবে সবাই পুলিশকে তাদের বন্ধু ভাববে? পুলিশের অনেক গৌরবগাথা রয়েছে। কিন্তু সাইফুল ও আকরামদের কর্মকাণ্ডে সেসব ম্লান হয়ে যায়। পুলিশকে আমরা উত্ত্যক্তকারীর ভূমিকায় দেখতে চাই না, যৌন হয়রানিকারীর ভূমিকায় দেখতে চাই না। চাই সত্যিকারের সেবকের ভূমিকায় দেখতে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক