দক্ষিণ এশিয়ায় চীন কি এগিয়ে?

১৯৪৭ সালে উপনিবেশবাদের পতন থেকেই ভারত দক্ষিণ এশিয়া রাজনীতিতে প্রভাবশালী শক্তি। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেও এখন আত্মপ্রকাশ করছে। কিন্তু একই সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতিতে বন্ধুহীনও হয়ে পড়ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতার ইতিহাস শুরু থেকেই। কিন্তু অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ যারা ভারতের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিল, তারা নতুন এক বলয়ের দিকে ঝুঁকছে। এই অঞ্চলে চীনকেন্দ্রিক নতুন বলয় ক্রমে দৃশ্যমানও হচ্ছে। মূলত বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে চীন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বলয়ের পুনর্গঠন করছে।

অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের পারস্পরিক বিশ্বাসের মাত্রা এমন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে যে এখন বাংলাদেশকে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে বলতে হয়, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধুই বাণিজ্যিক। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-চীনের মধ্যকার সম্পর্ককে নেহাতই বাণিজ্যিক বলে উল্লেখ করেছেন। মূলত, বাংলাদেশ তার বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে যেমন সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলবে, আবার বিশ্ব অর্থনীতির নতুন শক্তি চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রেখে সুবিধাও আদায় করে নিতে চাইবে। এটিই স্বাভাবিক। তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও সামরিক যোগাযোগ বাড়ছে। এটি ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

ভারতের এই উদ্বেগ তাদের বিভিন্ন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বক্তব্যে অনেকটাই প্রকাশ হয়ে পড়ছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশিরা অভিবাসী হিসেবে ঢুকে যাচ্ছে। পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে এই অভিবাসনপ্রক্রিয়া পরিচালনা করছে। আর পেছন থেকে এতে মদদ দিচ্ছে চীন। এসবই হচ্ছে এক ছায়াযুদ্ধের আড়ালে।

চীনের প্রভাব কীভবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বা ভারত কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে? চীন দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্যিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এগোচ্ছে। ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। বরং নতুন নতুন দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন নেপালকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ দ্বার হিসেবে বিবেচনা করছে। ২০১৭ সালে চীন নেপালে আট বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো বিনিয়োগ করেছে। সড়কপথ, রেলপথ, ফাইবার কেব্‌লের সংযোগসহ বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে চীন আরও ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাতেও বিনিয়োগের নামে চীনের উপস্থিতি ও প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টানাপোড়েনে চীনের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয়েছে। সব শেষে চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ভারতীয় কোম্পানিকে হটিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের শেয়ার কেনায় এগিয়ে আছে। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দেওয়ার প্রস্তাবসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে চীনারা। বাংলাদেশ চীন থেকে সাবমেরিন কিনে নিজের নৌশক্তি সমৃদ্ধ করেছে।

অন্যদিকে, ভারত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পরোক্ষ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করা চেষ্টা করছে। গঙ্গার পানি বণ্টর চুক্তি করলেও পানি প্রাপ্তি নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে সংশয় আছে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা নিয়মিত ঘটনা। রোহিঙ্গা বিষয়েও ভারতের অবস্থান কোনোভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন নিয়ে ভারত বিভিন্ন সময় মন্তব্য করে অবস্থান পরিষ্কার করেছে। মালদ্বীপেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটেও ভারত একই আচরণ করেছে। শ্রীলঙ্কাতেও বন্দর নির্মাণ ও বন্দরের নিরাপত্তার নামে চীনাদের জমি দেওয়ার বিষয়টি ভারত ভালোভাবে নেয়নি। সব মিলিয়ে ভারতের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।

ভারত নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই চীনের এই বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইবে। কিন্তু ভারতের প্রভাব যে সংকুচিত হচ্ছে, সেটি পরিষ্কার। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত বন্ধু হারাচ্ছে। বাংলাদেশই এখন ভারতের নির্ভরতার স্থান। নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা অনেক আগে থেকেই ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে এই তিনটি দেশ পাশে পাচ্ছে চীনকে। ভারত কখনই চাইবে না বাংলাদেশও চীনা বলয়ে যোগ দিক। কারণ, অন্য তিনটি রাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ওপর যদি ভারত নিয়ন্ত্রণ হারায় বা চীনের নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়বে।

এ কথা স্বীকার করতে হবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ এখন অনেক উষ্ণ। ভারত কখনই এই বাংলাদেশকে হাতছাড়া করতে চাইবে না। বাংলাদেশকে কবজায় রাখতে ভারত মরিয়া হয়ে চেষ্টা করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ জন্য ভারত বরাবরই চাইবে বাংলাদেশে বন্ধু সরকার ক্ষমতায় থাকুক। নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার নির্বাচন থেকে ভারত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই অভিজ্ঞার নিরিখেই বাংলাদেশবিষয়ক নীতি নির্ধারণ করবে ভারত। তাই চীন-ভারতের ছায়াযুদ্ধের আরেকটি একটি ক্ষেত্র হতে পারে বাংলাদেশ। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশকে দুই পক্ষ থেকেই চাপ মোকাবিলা করতে হবে। তবে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কীভাবে ভারসাম্য আনে, সেটিও দেখার বিষয়।

ভারত চীনের প্রভাবকে খর্ব করতে চাইলে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভারতকে সবার আগে প্রতিবেশী দেশে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। শুধু সরকার নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জনসাধারণের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। বন্ধু সরকারকে হয়তো কিছুদিন ক্ষমতায় রেখে কিছু কিছু স্বার্থ নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু এতে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান আসবে না। দীর্ঘ মেয়াদের সমাধান না এলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একাকিত্ব বাড়তেই থাকবে।

ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি