এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের শর্ত হলো মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকের যেকোনো দুটিতে সিডিপির নির্ধারিত মান অর্জন করতে হবে। সিডিপি জানিয়েছে, বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মান অর্জন করেছে। তবে এখনই বাংলাদেশের ‘স্বল্পোন্নত’ পরিচয় ঘুচছে না, অর্জিত অগ্রগতির ধারা আরও ছয় বছর বজায় থাকলে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের প্রবেশ ঘটবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। তাই সামনের এই ছয় বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিবেশ-পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূল নয়। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের ভাষায়, এই ‘বৈরী’ পরিবেশের মধ্য দিয়েই আমাদের আগামী ছয় বছর অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কতকগুলো চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলো মোকাবিলার প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। ১০ মার্চ ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজিত ‘এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ’ শীর্ষক এক সংলাপে কতকগুলো সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ এখন এলডিসি হিসেবে যেসব বাণিজ্যসুবিধা পায়, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার পর সেগুলো পাবে না। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এখন রেয়াতি সুদের ঋণ পায়। এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর তা পাওয়া যাবে না। ফলে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্কসুবিধা, মেধাস্বত্ব সুবিধা ইত্যাদি কমে যাবে, কিংবা উঠে যাবে। ফলে বিশ্ববাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরও প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। দেখা গেছে, এ ধরনের নানা কারণে অনেক দেশ এলডিসির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সমস্যায় পড়েছে। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে; রপ্তানি, বিদেশি সহায়তা, রেমিট্যান্সও কমেছে।

বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পোর ভাষ্য অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক বাড়বে। এর ফলে বাংলাদেশকে বছরে ২৭০ কোটি ডলার রাজস্ব দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের মতে, এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের আঘাত পড়বে।

আমাদের সামনে আরও কিছু বড় সমস্যা আছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। সামনের দিনগুলোতে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানচ্যুতি ও জীবিকার সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া গত বছর প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও পড়বে।

এসব সমস্যা মোকাবিলা করে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখনই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ জোরদার করতে হবে, সে জন্য জ্বালানি ও অবকাঠামোগত ঘাটতি দূর করতে হবে। রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাকের ওপর অধিক নির্ভরতা নয়, রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। মানবসম্পদের গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে সুদক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ব্যাপক ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে বেশি মনোযোগী হতে হবে। সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিতে হবে।