ভুল সবই ভুল, যা জানি তা ভুল

ভুলটা বোঝা গেল প্রথম আলোয় র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সাক্ষাৎকারটা পড়ে (প্রথম আলো, ১৮ মার্চ)। ভুলটা আমাদের শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদের নয়। বিশিষ্ট ব্যক্তি, ভিআইপিদের নাম উচ্চারণ করা বা লেখার আগে, অর্থাৎ নামের আগে বিশেষণ ব্যবহার করা এখন অলিখিত নিয়ম। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে খবর আছে। নেতা-নেত্রীর নামের আগে যত বেশি বিশেষণ ব্যবহার করা যায়, ততই মঙ্গল। বিশেষণ ব্যবহারকারী ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব মঙ্গলের আশায় বিশেষণগুলো দীর্ঘায়িত করেন।

দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। তখন লন্ডনে থাকতাম। কী যেন একটা রাজনৈতিক ব্যাপারে-ব্যাপারটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, আর সেটা এই কলমের জন্য মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়-একটা পত্রিকায় ওই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা এক সাংসদের (এমপি) চিঠি ছাপা হয়েছিল। জন মেজর তখন প্রধানমন্ত্রী। এমপি সাহেব চিঠিটা শুরু করেছিলেন ‘ডিয়ার জন’ সম্বোধনে। এই অধমের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। অতিমাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করছে শুধু ‘ডিয়ার জন’ বলে! দল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কেন যে বহিষ্কৃত হলেন না, তা আজও বুঝিনি। কার নামের আগে কয়টা বিশেষণ লাগাতে হয়, তার যথাযথ তালিম নেওয়ার জন্য তাঁর কিছুদিন বাংলাদেশে অবস্থান করা জরুরি।

তিন ভিনদেশে ছাত্র ছিলাম। বহু শিক্ষকের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে। অভদ্র হয়ে গিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে। তখন থেকে অধ্যাপকদের নাম ধরেই ডাকার বা সম্বোধন করার বদভ্যাস গড়ে ওঠে। কাউকে কোনো দিন ‘ছার’ (স্যার) বলিনি। শব্দটা এখনো সহজে মুখ দিয়ে বেরোতে চায় না। সতর্ক থাকা ভালো, পাছে না ‘মাইন্ড’ করে ফেলেন। তাই শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ।

ভারতের সংবিধানে পইপই করে ‘টাইটেল’ ব্যবহার নিষেধ করে দিয়েছে। ব্যতিক্রম দুটো, যার সাদামাটা অর্থ হলো শিক্ষক আর সেনা কর্মকর্তারা টাইটেল ব্যবহার করতে পারবেন। অধ্যাপক ও মেজর জেনারেল চলে গা!

যাহোক, আপাতত শ্রদ্ধেয়ই থাক।

২.
শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদের সাক্ষাৎকার পড়ে উপলব্ধি হলো যে এক যুগ ধরে ক্রমান্বয়ে ভুল করে চলেছি। সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল ‘ “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড” একটা ভুল শব্দ’। তাই তো, এত দিন ধরে ভুল শব্দ ব্যবহার করে বিরাট ভুল করে চলেছি।

লিখছি আর ভাবছি, একজন সম্পাদক বছর দুয়েক আগে অকপটে একটা কথা স্বীকার করেছিলেন। তিনি বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা খবর যাচাই-বাছাই না করে ছাপার কথা স্বীকার করে তাকে ভুল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এরপর এক শ পুরো না হলেও এক শর কাছাকাছি মামলা খেয়েছিলেন!

অকপটে ভুল স্বীকার করার জন্য তো মামলা হওয়ার কথা নয়। সেটাই ভরসা। অবশ্য আরও ভরসা এটুকু যে বছরের পর বছর ধরে এই ভুল অগণিত ব্যক্তি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি গণমাধ্যমও করে আসছে। আমাদের চরম সৌভাগ্য যে শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ আমাদের সবার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন; এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় না। থ্যাংক ইউ!

অবশ্য তিনি প্রশ্নও রেখেছেন-বিচার-অন্তর্ভুক্ত হত্যাকাণ্ড কোনটি।

৩.
ভুল বুঝে অনেক ভুল বা খারাপ কাজ করা হয়ে যেতে পারে। আগের বাক্যটা স্বীকারোক্তি নয়, মূল্যায়ন। ভিন্ন মূল্যায়নের জন্য মামলা খাওয়া (!) উচিত নয়। যাহোক, যা বলছিলাম, বছর আড়াই আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের বড় হলরুমে তিরিশের বেশি পরিবার সমবেত হয়েছিল। কারও ছেলে, কারও বাবা, স্বামী, ভাই নিখোঁজ। আমরা তাদের আহাজারি শুনেছিলাম প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। তাদের প্রায় সবাইকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই অফিস, ওই অফিসে ধরনা দিয়েছে।

ছেলে হারানো বৃদ্ধ মা, বাবা হারানো বালকের কথা শুনতে শুনতে আমাদের অনেকের চোখের জল বাধ মানছিল না।

পরদিন প্রায় সব পত্রিকাতেই স্বজনহারাদের আহাজারির বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছিল।

এখন বুঝতে পারছি-সবই ভুল। তাঁরা হয় আর্থিক-ব্যবসায়িক কারণে সটকে পড়েছেন; পারিবারিক বা বৈধ-অবৈধ প্রেমজনিত কারণে গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এসব করেছেন। কেউই গুম হননি। মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে।

সাক্ষাৎকারে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে-বিচার বিভাগ কি আর স্বাধীন! ধারণা করছি, নারায়ণগঞ্জের সাত ব্যক্তি প্রথমে নিজেদের মেরেছেন। মরার পর নিজের পেট কেটেছেন। তারপর দড়ি দিয়ে পায়ে-পেটে পাথর আর ভারী বস্তু বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। আর শেষে আমজনতা, মিডিয়া আর আইনজীবীদের চাপে পরাধীন বিচারক র‍্যাবের কর্মকর্তা আর তাঁদের সঙ্গী ব্যক্তিদের অকারণে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির আদেশ দিয়েছেন। কারণ, র‍্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম কিছুই করে না। সবই আমাদের ভুল ধারণা।

৪.
শুধু ভুলটাই শোধরাতে পারছি, তা নয়। নতুন তথ্যও জেনেছি সাক্ষাৎকার থেকে। প্রথম আলো প্রশ্ন রেখেছিল-‘এভাবে সামরিক বাহিনীকে যুক্ত করে বিশ্বের কোথাও এ রকম বাহিনী আছে কি?’ জবাবে অতি শ্রদ্ধেয় বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘না, এ ধরনের বাহিনী অনন্য।’

দুনিয়ায় কেউ বুঝল না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাসদস্যদের সম্পৃক্ত রাখলে সুফল মেলে। বুঝল শুধু আমাদের সরকার আর র‍্যাব। আর র‍্যাব সৃষ্টির জন্য বর্তমানে ডান্ডাবেড়ি লাগানো যে ব্যক্তির ছবি প্রিজন ভ্যান থেকে নামার সময় মাঝেমধ্যে মিডিয়ায় দেখা যায়, অর্থাৎ লুৎফুজ্জামান বাবরের নাম উল্লেখ না করলে নিঃসন্দেহে ইতিহাস বিকৃতির অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

যারা র‍্যাবকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, র‍্যাবের সঙ্গে এনগেজমেন্টে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায়, তারা তো মরতেই পারে এবং মরছেও। এটাই স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে সাক্ষাৎকারের মূল বক্তব্য ছিল এটাই। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিক রাখার জন্য ‘লাইসেন্স টু কিল’ প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় ভুলটা এ জায়গায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে এক দশক ধরে যে কথা বলে চলেছি এবং বলতেই থাকব তা হলো-সফল রাষ্ট্র। দুর্বল রাষ্ট্র আর ব্যর্থ রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য মূলত একটা ব্যাপারে। দুর্বল রাষ্ট্র নিজেকে সফল রাষ্ট্রে পরিণত করতে ক্রমান্বয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বেশি বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর বহিঃপ্রকাশ প্রধানত দুই ধরনের। প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাজেট বাড়ে, প্রযুক্তি-অস্ত্রশস্ত্র বাড়ে আর সেই সঙ্গে কমে জবাবদিহি। আস্তে আস্তে ধরো, মারো থেকে ক্রমান্বয়ে অপহরণ, চাঁদাবাজি, জমি দখল ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের বিস্তৃতি ঘটে। সেই সঙ্গে প্রতিবাদীদের সংখ্যা কমতে থাকে। দ্বিতীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যাংক-বিমা, কনস্ট্রাকশন মেরামত, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ইত্যাদি। ফল হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হতে থাকে।

আর যার জবাবদিহি নেই, তাকে জবাবদিহি করার চেষ্টা করা অর্থহীন। এটা গণমাধ্যমের ভুল। প্রথম আলো এই ভুলটি করেছে।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক