আওয়ামী লীগের ঘাড়ে 'কোন্দলের' বোঝা

কোন্দল ও মারামারি ঠেকাতে নেতাদের হাতজোড় যথেষ্ট নয়
কোন্দল ও মারামারি ঠেকাতে নেতাদের হাতজোড় যথেষ্ট নয়

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) হাতে মানিকগঞ্জে ধরা পড়া ১০ জনের একটি সশস্ত্র অপহরণ চক্র সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও সামাজিক অবক্ষয় গভীরতর হওয়ার ইঙ্গিতবহ। আওয়ামী লীগ সমাজের অংশ, তাই সেখানেও বড় সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জঙ্গি দমলেও সমাজে চরমপন্থা ক্রমে বাড়ছে।

দলীয় কোন্দলের পেছনে আসলে কোনো মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব নেই কিন্তু তথাকথিত কোন্দলে গত এক দশকে দুই শর বেশি আওয়ামী লীগার বা তার সমর্থক খুন হয়েছেন। এর বিচার বিরল, তবে ফেনীর আদালত সম্প্রতি ৩৯ জনকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন। নিহত ব্যক্তি উপজেলা চেয়ারম্যান ও দলীয় সভাপতি ছিলেন। তাঁকে গুলি করে, পেট্রল ঢেলে গাড়িসুদ্ধ জীবন্ত হত্যা করল দলীয় সহযোদ্ধারাই। টাঙ্গাইলেও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যার আসামি সাংসদ আমানুর রহমান। এর বাইরে কোথাও দুষ্কৃতকারীরা দলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দেখাচ্ছে।

১৯৯০ সালের পর প্রতি পাঁচ বছর পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের কারণে কোনো দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা দুর্বৃত্তায়নের ধারা স্থায়ী রূপ নেয়নি। মাঝখানে ছেদ পড়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন টানা দুই মেয়াদের শেষ দিকে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের রাশ টেনে ধরা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, মানিকগঞ্জের ঘটনাই তার প্রমাণ। একজন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীকে রাতারাতি ও বেআইনিভাবে দলের উপজেলা সহসভাপতি করা কি প্রমাণ করে যে দলটি ভেতর থেকে ধসে পড়ছে? এই লোকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ‘ভোট কিনে’ স্কুল কমিটির টানা দুই মেয়াদে সভাপতি হন। এমন ঘটনা বিরল নয়।

আগে সরকারি দল এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলো চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির মতো দুর্নীতি ও মাঝেমধ্যে ছোটখাটো সংঘাতে লিপ্ত হতো। সেই চিত্র ভয়ানকভাবে পাল্টেছে। নামে-বেনামে দলটির একটি অংশ নরহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়েছে। কিন্তু এই সত্য স্বীকার করতে তারা কুণ্ঠিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের চতুর্থ রিপোর্ট বলেছে, দুই মাসে (গত নভেম্বর-ডিসেম্বর) ২৪ ঘটনায় ২৬৭ ব্যক্তি আহত হন, যার মূলে দলীয় কোন্দল।

রিপোর্টে দলের নাম নেই; কিন্তু তা উল্লেখ করার দরকার হয় না। মারামারির ঘটনায় দল ব্যবস্থা নেয় না-এমন অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর উক্তি ছিল, ‘ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। তারা সেটা করে। দলের লোক মারামারি করেছে, এটা
পত্রপত্রিকা বলে। কিন্তু নিজেরা খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় না। তাহলে কীভাবে ব্যবস্থা নেব?’ দুই বছর আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজবাহউদ্দিন সিরাজ বলেছিলেন, ‘আমাদের দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, কোন্দল নাই।’ তাঁরা উভয়ে ভ্রান্ত, কিন্তু তাঁদের সাফাই বক্তব্যের সমর্থকেরা যে দলে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতীয়মান হবেন, তাতে আর সন্দেহ কী?

২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে নিহত ১১৬ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকই ছিলেন ৭১ জন। ফেনীর ওই নৃশংস খুনের নেপথ্যের দুটি বড় কারণ, একজন ইউনিয়ন পরিষদে দলের চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে পরেননি, আরেকজন ডায়াবেটিক সমিতির নির্বাচন করতে পারেননি। প্রশ্ন হলো দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেই কি আধিপত্য বিস্তারের যে সর্বনাশা মোহ দলে যাদের পেয়ে বসেছে, তারা ভড়কে যাবে, নাকি দলকে রাজনৈতিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায়ও মনোযোগ দিতে হবে?

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘মারামারি বা অপরাধ করে রাজনৈতিক দলে কারও পদ গেছে, এর নজির কম। পদ যায় রাজনৈতিক কারণে।’ অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পত্রিকান্তরে বলেছিলেন, ‘দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়ে তাঁদের দলীয় ফোরামে আলোচনা হয় না বললেই চলে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেটা প্রকাশিত হচ্ছে, সেটা দেখে অনেক সময় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে সাত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের ঢাকায় অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাঁদের প্রভাব না থাকায় কোন্দল কমছে না।’
লক্ষণীয় রূঢ় সত্য বোঝার মতো বিবেকবান ব্যক্তি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগে আছেন, কিন্তু তাঁদের শর্ত অভিন্ন, নাম প্রকাশ করা যাবে না। আশা করব, এই বিবেকবানেরা বিবেচনায় নেবেন যে প্রধান বিরোধী দল খুব বেশি দুর্বল হলে তা ক্ষমতাসীন দলের বৈধ স্বার্থ রক্ষা করে কি না। ফলপ্রসূ ‘একদলীয়’ ব্যবস্থার শক্তি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়ণ ও শৃঙ্খলা রক্ষা, বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে যা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং।

নীতিহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির রাশ না টানলে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন। এর মধ্যে যাঁরা মামুলি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন আর খুনখারাবি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করেছেন, তাঁরা একাকার হয়েছেন।

মানিকগঞ্জে আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশে নিম্নবিত্ত অবস্থান থেকে উঠে আসা পিতা-পুত্র যেভাবে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং বিদ্যাপীঠের সম্পদ লুটের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটা সম্ভবত সমাজে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

মানিকগঞ্জের সেলিম মোল্লার কথিত দলীয় ‘টর্চার সেল’ (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থে গড়া ডুপ্লেক্স) ইতিমধ্যে দেশের বহু স্থানে একটি অশুভ প্রবণতায় রূপ নিয়েছে। তাঁরা হয়তো দেখছেন, একই সঙ্গে বহু বাহিনী গুম বা ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য নাটকীয়ভাবে তুলে নেয়। বেসরকারি বাহিনী দায়টা তখন বিভ্রান্তিকরভাবে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারে। আইনের শাসন যত দুর্বল হবে, ততই প্রাইভেট বাহিনী বাড়বে। রাশ না টানলে দলের ছত্রচ্ছায়ায়, নামে-বেনামে পদ্ধতিগত প্রাইভেট বাহিনীর বিস্তার ঘটতে পারে। এলিট ফোর্স নয়, দলীয় শুদ্ধি অভিযানই এদের রুখতে পারে।

এ জন্য দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের জীবনযাপন ও ব্যয়ের অসংগতি যাচাইয়ে একটি বড় ধরনের সাংগঠনিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। বড় উন্নয়নে বড় দুর্নীতি হওয়ার ধারণা আমরা প্রত্যাখ্যান করি। কারণ, এটা স্বীকৃত ও পরীক্ষিত যে দুর্নীতির গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানো সমাজে উন্নয়ন টেকসই বা সুষম হয় না। দুর্নীতি দলে কোন্দল ও খুনখারাবি বাড়াচ্ছে।

গত বছর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের ‘অভ্যন্তরীণ কোন্দলে’ একটা বন্দুকযুদ্ধ হলো, তাতে সমকাল-এর সাংবাদিক প্রাণ দিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি সাংবাদিকের স্ত্রীকে একটি চাকরি দিয়েছেন। এর একদিকে স্থানীয় সেই সাংসদ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) হাসিবুর রহমান, ১৯৯৬ সালে বিএনপি ত্যাগ করে নৌকায় চেপে উপমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে ৪২০ ধারায় অভিযুক্ত হওয়ার তথ্য তাঁর গত নির্বাচনী হলফনামায় ছিল না। তাঁর অনুসারী দলের পৌর কমিটির সভাপতির সঙ্গে বর্তমান মেয়রের গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের বন্দুক লড়াই থেকে ওই খুন। সেই হত্যা মামলায় মেয়র দলের পদ থেকে বরখাস্ত ও কারাবন্দী অথচ অন্যজন পৌর কমিটির সভাপতি পদে বহাল।

টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা খুনের আসামি আওয়ামী সাংসদ বন্দী, কিন্তু তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হননি। দল বলেছে, আদালতে ফয়সালার পর সিদ্ধান্ত। তাহলে শাহজাদপুরের আওয়ামী মেয়র কী দোষ করেছেন? ফেনীতে খুনের পরপরই কমিটি হয়, তাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বাদ পড়েন, দল এখনো কাউকে বহিষ্কার করেনি। দলের কমিটিতে অন্তত খুন ও গুমের মতো ঘটনায় অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত ব্যক্তিদের থাকতে হলে কী নিয়ম, কী নৈতিকতা, তার একটা ফয়সালা দরকার।

আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার বার্তা না দিতে পারলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা নীরবে অশ্রুপাত করবেন। ‘চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার ক্ষমতা কেবল আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ খুনখারাবি প্রতিরোধে দলটির কার্যনির্বাহী সংসদের উদ্যোগ জরুরি।

মিজানুর রহমান খান : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail. com