বিদ্যুৎ খাতের বিষ নামবে না, দামই বাড়বে শুধু

আমদানিনির্ভর উচ্চমূল্যের জ্বালানির বিষে বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যৎ আরও নীল হয়ে যাওয়ারই আশঙ্কা
আমদানিনির্ভর উচ্চমূল্যের জ্বালানির বিষে বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যৎ আরও নীল হয়ে যাওয়ারই আশঙ্কা

গত সাত বছরে সাতবারেরও বেশি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাসভিত্তিক সস্তা বিদ্যুতের পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন তেলভিত্তিক দামি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়া, দায়মুক্তি আইনের আশকারায় স্বল্পমেয়াদি রেন্টাল-কুইক রেন্টালের খরুচে উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদি রূপ পাওয়া—এসবই বিদ্যুৎ খাতের চলমান সংকটের নমুনা। উৎপাদন যেনতেনভাবে বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের আজাব গেছে ঠিকই, তবে আমদানি করা কয়লা আর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ ব্যবহারে বাধ্য হওয়া গজবের দিন সামনে অপেক্ষা করছে। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা হিসেবে খ্যাত ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান’-এর (পিএসএমপি-২০১৬) সর্বশেষ দলিল আমাদের এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে।

পিএসএমপি অনুসারে ২০৪১ সাল নাগাদ মোট বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশ কয়লা আর ৩৫ শতাংশ গ্যাস এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে উৎপাদনের ছক কাটা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য বা আমদানীকৃত, ১০ শতাংশ পারমাণবিক এবং ৫ শতাংশ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ সরল সংখ্যাগুলোর আড়ালে হিসাবের মারপ্যাঁচে অনেক জটিলতা আড়ালে পড়ে যায়। যেমন বাংলাদেশে উন্মুক্ত কয়লা খনন পদ্ধতির বিরুদ্ধে জোরালো সামাজিক প্রতিরোধ জারি থাকায় কয়লা উত্তোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অথচ এ মহাপরিকল্পনায় কৃষি আর পানিসম্পদ রক্ষার যুক্তিতে কয়লাখনির বিরুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিরোধের বিষয়টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ২০৪১ সালের মধ্যে বছরপ্রতি ১১ মিলিয়ন টন কয়লা স্থানীয়ভাবে উত্তোলনের কথা বলা হয়েছে, যা বর্তমানে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন টন (পিএসএমপি-২০১৬, পৃ. ১-৩)। সেই সঙ্গে খরচ, দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি—এসব বিবেচনায় না নিয়েই সর্বমোট ১৯ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ পাশের দেশ ভারতে অন্যান্য সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে চাহিদা কমে গিয়ে ক্রমাগত লো-ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টরে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলতে চলতে এতটাই নাজুক অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে খরচের বোঝা থেকে বাঁচতে গত বছর টাটা পাওয়ার চার হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মুন্দ্রা কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৫১ শতাংশ শেয়ার মাত্র এক রুপি প্রতীকী মূল্যে বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। (দ্য হিন্দু, ২২ জুন, ২০১৭)। অন্যদিকে, চীন দূষণের হাত থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা ১ লাখ ২০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার ১০৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭)। আশ্চর্যজনকভাবে পিএসএমপিতে ঘোষিত প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নিজ দেশে কয়লা প্রকল্পগুলো নিয়ে ভুগতে থাকা ভারত ও চীন যথাক্রমে রামপাল ও বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ করছে।

বাংলাদেশের স্থল ও সমুদ্রসীমানায় আরও অন্তত ৩২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে (পেট্রোবাংলা রিপোর্ট, জুন, ২০১১)। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে যেনতেনভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাঝেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সীমাবদ্ধ। গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের উচ্চমানের কাজের প্রশংসা সত্ত্বেও অতিরিক্ত খরচে গ্যাসকূপ খনন করতে কাজ দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানি গাজপ্রম আর ওএনজিসিকে (সর্বজনকথা, নভেম্বর, ২০১৬, পৃ. ৪৬-৫২)। শুধু তা-ই নয়, বাপেক্সের কাজ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করায় বাপেক্সের এমডি মো. আতিকুজ্জামানকে বাপেক্স থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে (বণিকবার্তা, ২০ নভেম্বর, ২০১৬)। আর এই বিদেশি কোম্পানি এবং আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির কৌশলে যে প্রতিবছরই গ্যাস আর বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়াতে হবে, তা পিএসএমপিতে হিসাব কষে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে (পিএসএমপি-২০১৬, পৃ. ১-৯৮)।

বাড়তে থাকা খরচের কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের ওপর অধিক মনোযোগী এ দলিলে সস্তা নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে যে মাত্র ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি অর্জনের হিসাবে আবার গোঁজামিল দিয়ে অঙ্ক মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে এই ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নবায়নযোগ্য অথবা আমদানি করা বিদ্যুৎ দিয়ে মেটানো হবে। অথচ ২০৪১ সালের মধ্যে আমদানি করা নয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি অর্জিত হয়ে গেলে এ মহাপরিকল্পনা অনুসারে বাংলাদেশে আর কোনো সৌর এবং বায়ুবিদ্যুৎ স্থাপনের প্রয়োজনই হবে না। (পিএসএমপি-২০১৬, পৃ. ১১-৩৪)। অথচ পাশের দেশ ভারতে সৌর এবং বায়ু থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এখনই সাড়ে তিন টাকারও কম মূল্যে উৎপাদিত হচ্ছে। (http://mnre. gov. in/)। সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যেই অজীবাশ্ম (সৌর, বায়ু, বর্জ্য, ছোট এবং বড় আকারের বাঁধভিত্তিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প) উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ (দ্য গার্ডিয়ান, ২ অক্টোবর, ২০১৬)। আর জার্মানিতে এই টার্গেট ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ (ইনডিপেনডেন্ট, ৫ মে, ২০১৭)।

সাশ্রয়ী বিদ্যুতের অভিনব সব উপায় কাজে লাগিয়ে জার্মানি, জাপান, ফ্রান্সের মতো একসময়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের ওপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল দেশগুলো যখন এই ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ থেকে সরে আসছে, বাংলাদেশে তখন সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ খরচ চার বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেলেও হলেও সস্তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের মিথ্যা আশা বিলানো থামছেই না। আর ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনার মতো ভবিষ্যৎ কোনো দুর্ঘটনার দায় থেকে মুক্তি পেতে ইতিমধ্যেই করে ফেলা হয়েছে দায়মুক্তি আইন (পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন, ২০১৫ দ্রষ্টব্য)।

বিদ্যুৎ খাতে সংকটের বিষ নামানোর নাম করে এই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। অথচ আমদানিনির্ভর উচ্চমূল্যের জ্বালানির বিষে বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যৎ আরও নীল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই দেখা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় গ্যাস এবং নবায়নযোগ্য সম্পদ কাজে লাগিয়ে সংকট সমাধানের বিকল্পও রয়েছে। গবেষণা বরাদ্দ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আর নীতিনির্ধারণী উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে পারলে সংকটাপন্ন বিদ্যুৎ খাতের নিরাপদ ও সস্তা সমাধানের নিয়তিতে পৌঁছানো খুবই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নিয়তটা ঠিক করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

লেখক: প্রকৌশলী, জ্বালানিপ্রযুক্তি-বিষয়ক গবেষক।
[email protected]