শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য

>

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হলো।

আলোচনায় সুপারিশ

* টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটে শিশুর দারিদ্র্য বিবেচনা করা প্রয়োজন

* শিশুর দারিদ্র্যকে বয়স্কদের চোখ দিয়ে না দেখে শিশুদের চোখ দিয়ে দেখা জরুরি

* জাতীয় বাজেটে শিশুর জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে

* বিভিন্ন শ্রেণির শিশুর দারিদ্র্য মোকাবিলায় বহুমুখী নীতিমালা প্রয়োজন

* আনন্দময় শৈশব উপহার দেওয়ার জন্য শিশুর ওপর পরীক্ষা-পদ্ধতির চাপ কমাতে হবে

* শিশুদের মতামত নিয়ে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে হবে

* সামাজিক নিরাপত্তাকৌশলের প্রভাবগুলো যথাযথভাবে পরিমাপ করা প্রয়োজন

* শিশুরা যেন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত না হয়, সেটা িনশ্চিত করা জরুরি

* বহুমাত্রিক দারিদ্র্য িনরসনে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর একসঙ্গে কাজ করতে হবে

* শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বাধাগুলো দূর করা প্রয়োজন

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম: শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করা হয় না। দারিদ্র্য বলতে সাধারণভাবে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়াকে বোঝানো হয়। কিন্তু দারিদ্র্য বহুমাত্রিক, যেমন শিক্ষার দারিদ্র্য, বাসস্থানের অভাব, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নিম্নমান ইত্যাদি। তবে শুধু প্রবৃদ্ধির মানদণ্ডে হিসাব করার কারণে এ বিষয়গুলো তেমন আলোচনায় আসে না। এসব িবষয় িনয়ে আজকের আলোচনা। এখন আলোচনা করবেন শামসুল আলম।

শামসুল আলম
শামসুল আলম

শামসুল আলম

বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ শিশু। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয়। দৈনন্দিন ন্যূনতম ২ হাজার ২২১ ক্যালরি খাদ্য ক্রয় করার সক্ষমতাকে মৌলিক চাহিদা হিসেবে ধরে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয়।

আয় দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ একটি খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ, আয়ের ভিত্তিতে মানুষের দারিদ্র্য অনেক সময় বোঝা যায় না। আয়ের দিক থেকে দারিদ্র্যসীমার ওপর বাস করলেও কোনো কোনো পরিবারে িশশুরা অসুস্থ থাকতে পারে, উন্নত বাসস্থানের অভাব থাকতে পারে, আবার শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই বহুমাত্রিকভাবে দারিদ্র্য বিবেচনার বিষয়টি অনেক দেশ গ্রহণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের কথা বলা হয়েছে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সূচক দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হলে বাংলাদেশে দরিদ্রের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। জনজীবনের প্রকৃত অবস্থা বুঝে দারিদ্র্য িনরসন তথা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপই যথোপযোগী পদ্ধতি। শিশুদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

বাংলাদেশ সরকার ১ জুন ২০১৫ তারিখে একটি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র গ্রহণ করেছে। সেখানে জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। একটি শিশুকে গর্ভকালীন সময় থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সব শিশুকে নিরাপত্তার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। সব শিশুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাবৃত্তি নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। টিকাদান, শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, পয়োনিষ্কাশন কর্মসূচি শক্তিশালী করার দিকগুলোতে জোর দেওয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০২৫ সালের মধ্যে সব শিশুর পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিশুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিশুদের সব ধরনের শ্রম থেকে বিযুক্ত করা, সহিংসতা রোধে নিরাপত্তা দেওয়া, পুষ্টির নিশ্চয়তা, তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। সুতরাং, নীতিগতভাবে বাংলাদেশ সরকারের কতগুলো কাঠামো রয়েছে। এখন সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ।

মো. মনিরুল ইসলাম
মো. মনিরুল ইসলাম

মো. মনিরুল ইসলাম

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) প্রস্তাবনায় সব সদস্যরাষ্ট্র সব ধরনের দারিদ্র্য দূর করাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পুরুষ, নারী ও শিশুদের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। শিশুর বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ করে তাদের দারিদ্র্য কমানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।

এসডিজি কার্যক্রম মনিটর করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরাম গঠন করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সেখানে অংশগ্রহণ করে। যেখানে অন্যান্য ৪৩টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলে ধরে, সেখানেও বাংলাদেশ সরকার বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে যথাযথ নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার কথা বলে এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের সূচক গ্রহণের অঙ্গীকার করে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে শুধু আয় দারিদ্র্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব নয় । দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে তাই দারিদ্রে্যর বিভিন্ন মাত্রাকে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় এনে দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় । যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো স্কুলে উপস্থিতি এবং স্কুল সমাপ্তি, অর্থাৎ ঝরে না পড়া । আবার জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে িববেচ্য িবষয়গুলো হলো রান্নার জ্বালানি, পয়োনিষ্কাশন, নিরাপদ পানীয়, বিদ্যুৎ, বাসস্থান ও সম্পদ।

বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক ধরে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০১৭ সালে ১০৩টি দেশকে বিবেচনায় নিয়ে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে দেখা যায়, দেশগুলোর ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়ন উদ্যোগের (ওপিএইচআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার। এর মধ্যে একটি বিশাল অংশ রয়েছে শিশু। তাই আমাদের শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য দূরীকরণে যথাযথ সক্ষমতা অর্জনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

ফাহমিদা খাতুন
ফাহমিদা খাতুন

ফাহমিদা খাতুন

দরিদ্র শিশুরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ কম পায়। অল্প বয়সে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে নিম্ন মজুরির কাজগুলো করতে হয়। এ জন্য তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারে না। তার পরিবারের শিশু তাই দরিদ্র হয়েই জন্ম নেয়। বর্তমানে ৪৬ শতাংশ শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। তাদের দারিদ্র্য মোকাবিলায় এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দারিদ্র্য আরও বাড়বে।

বর্তমানে প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ, আধুনিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে হলে প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজনের শিকার হচ্ছে শিশুরা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) বাংলাদেশে শিশুর দারিদ্র্য, শিশুমৃত্যু কমেছে, শিশুর শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ব্যাপ্তি আরও বেশি। তাই বাংলাদেশকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিশুর জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।

শিশুর শিক্ষার কথা বলা হলেও দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু শিক্ষা নিতে পারছে না। তাকে কর্মজগতে প্রবেশ করতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষার সুযোগ সচ্ছল পরিবারগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। তাই শিশুর জন্য যে কর্মসূচিগুলো রয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটা দেখতে হবে। শুধু কর্মসূচি গ্রহণ করলেই চলবে না, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সচ্ছল পরিবারের শিশুদের মধ্যে ভিন্নমাত্রার দারিদ্র্য বিদ্যমান। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকারের সুযোগ থাকলেও তারা মানসিক দারিদ্র্যে ভোগে। শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় নীতিমালা প্রণয়নে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শিশুদের ভিন্নমাত্রার দারিদ্র্যকেও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। একমুখী নীতিমালা দিয়ে শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য দূর করা যাবে না।

লায়লা খন্দকার
লায়লা খন্দকার

লায়লা খন্দকার

শৈশব শিশুর গঠনমূলক সময়। এ সময় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও আবেগগত বিকাশ ঘটে। শিশুর যথাযথ বিকাশ বাধার সম্মুখীন হলে পরবর্তী জীবনে তার মানবিক সম্ভাবনার বিকাশ ব্যাহত হয়।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ২৭ অনুচ্ছেদে প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানের কথা বলা আছে। জীবনযাত্রার মানে রান্নার জ্বালানি, পয়োনিষ্কাশন, নিরাপদ পানীয়, বিদ্যুৎ, বাসস্থান ও সম্পদকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু জীবনযাত্রার মানকে আরও বড় পরিসরে দেখা প্রয়োজন।

যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুড চাইল্ডহুড: এ কোয়েশ্চন অব আওয়ার টাইমস’ নামের গবেষণায় ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১১ হাজার শিশু অংশ নেয়। গবেষণায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলেই মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ে না। গত ৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে গড় আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু মানুষ আগের তুলনায় বেশি সুখী নয়। উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থার বিপরীতে অল্প বয়সীদের আবেগগত সমস্যা, হতাশা, মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশের শিশুরা একদিকে অপুষ্টির শিকার, স্কুলে যেতে পারছে না, ঝরে পড়ছে, স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে, শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরাও ভালো নেই। দ্রুত নগরায়ণের ফলে প্রথাগত পারিবারিক কাঠামো ভেঙে গেছে। ফলে শিশুদের জীবনে আবেগ–সংক্রান্ত দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে। শিশু অন্যের সঙ্গে মানসিকভাবে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে না।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ সালে প্রতি মাসে গড়ে ১৮টি শিশু হত্যা এবং ৩৯টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মিলিত আরেকটি জরিপে দেখা যায়, জরিপের পূর্ববর্তী এক মাসে ১২-১৪ বছর বয়সী ৮২ শতাংশ শিশু শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতনকারী তার মা-বাবা কিংবা তত্ত্বাবধায়ক এবং তার শিক্ষক।

কিশোরেরা ‘গ্যাং সংস্কৃতি’, মাদকাসক্তি, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মা-বাবা তাঁদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। শিশুদের মা-বাবা, শিক্ষক কিংবা তত্ত্বাবধানকারীদের মধ্যে এখনো আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের পরিপূর্ণ মানবিক সম্ভাবনা বিকাশের ধারণাটির ঘাটতি রয়েছে।

হাসিনা বেগম
হাসিনা বেগম

হাসিনা বেগম

আমরা যদি চাই শিশুরা সমাজে পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক, তাহলে তাদের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ হবে না। শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সঙ্গে তিনটি বিষয় সম্পৃক্ত। এক. দারিদ্রে্যর বিভিন্ন মাত্রা যেমন পরিবারের আয়, জীবন মান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি; দুই. বিভিন্ন মাত্রার মধ্যকার আন্তসম্পর্ক ও তিন. এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে দারিদ্র্যের বিস্তৃতি। শিশুবিষয়ক তথ্য ও উপাত্তকে এই তিনটি বিষয়ের আলোকে বিশ্লেষণ করে শিশুর দারিদ্র্য মোকাবিলায় সমন্বিত নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

তবে সমন্বিত নীতিমালা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন দুর্বল বাস্তবায়ন, সেবা গ্রহণে সমান সুযোগের অভাব, কুসংস্কার ও সামজিক বাধা ইত্যাদি। তাই শুধু নীতিমালা নির্ধারণ, কর্মসূচি গ্রহণ এবং বিনিয়োগ করলে হবে না; এমনভাবে নীতিমালা ও কর্মসূচি ঠিক করতে হবে, যেন সেবাগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।

দরিদ্র শিশুরা প্রাথমিকভাবে পুষ্টির ঘাটতিতে ভোগে, শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পায় না। একপর্যায়ে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারা কম যোগ্যতা, কম উৎপাদনক্ষমতা এবং কম মজুরির ফাঁদে পড়ে যায়। ফলে অসচ্ছল পরিবারের শিশুরা দারিদ্র্যে ভোগে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত নীতিমালা। কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশকগুলো নির্ধারণ করা। এরপর সমন্বিত নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থাকে যৌথভাবে অর্থায়নের ঘাটতিসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দিকে নজর দিতে হবে।

রোকেয়া কবীর
রোকেয়া কবীর

রোকেয়া কবীর

দারিদ্র্যকে শুধু আয় দিয়ে হিসাব করলে হবে না। সামগ্রিক জীবনযাত্রা বিবেচনায় নিয়ে দারিদ্র্যকে দেখা প্রয়োজন। একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের দারিদ্র্যকে পরিবারের আয় দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। যেমন পরিবারের পুরুষের জীবনমানের সঙ্গে নারীর জীবনমানের পার্থক্য রয়েছে। সামাজিকীকরণসহ অন্যান্য অধিকারের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়।

শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে শিশুদের মানসিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সেটা হয় না। বয়স্ক ও শিশুদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে অনেক ভিন্নতা থাকে। কিন্তু বয়স্করা তাদের মতো করে শিশুদের দেখে।

শিশুকে শুধু জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে দেখলে হবে না। তাদের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। শিশুকে মানুষ হিসেবে দেখলে সিদ্ধান্ত এক রকম হবে, আবার তাকে শুধু উৎপাদনের শক্তি হিসেবে দেখলে সিদ্ধান্ত ভিন্ন হবে। শিশুর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি মানবিক বিকাশের দিকে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। তার সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উৎপাদনক্ষমতা এবং মানবিক বিকাশ দুটিকেই বিবেচনায় নিতে হবে।

সাধারণভাবে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের মধ্যে দায়িত্বের তুলনায় ভোগের মানসিকতার বেশি বিকাশ ঘটে। ফলে তারা বড় হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলে দরিদ্র শিশুদের সমস্যাগুলোকে বুঝতে পারে না। তাদের মানবিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

শিশুর প্রকৃত বিকাশের জন্য শুধু তার যথাযথ লালন-পালন নয়; বরং গর্ভকালীন মায়ের স্বাস্থ্যগত পরিচর্যায় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শিশুর অধিকারের সঙ্গে নারীর অধিকারও জড়িত।

কার্লোস অকাসটা
কার্লোস অকাসটা

কার্লোস অকাসটা

শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলার প্রক্রিয়ায় অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ এটাকে জাতীয় নীতিমালার প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক করে তোলা, কর্মসূচি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসা। এর মধ্যেই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের বড় সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের একটি সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। কোন মন্ত্রণালয় কোন কাজ করবে, কখন করবে এবং কার সঙ্গে করবে, তা এই কৌশলপত্রে নির্দিষ্ট করা আছে। তবে সেখানে ধারণাগত দিক থেকে সমস্যা রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তাকৌশলকে সাধারণত দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তাকৌশলের অনেক কিছু শুধু দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত নয়। এর আরও কতকগুলো দিক আছে। যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদান। শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের স্কুলে উপস্থিতি বাড়ানোর মাধ্যমে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ কমিয়ে আনা যায়। এই প্রভাবগুলো শুধু আয় কিংবা দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাই সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে দারিদ্র্য কমানোর কৌশলের বাইরে এনে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তাকৌশলের প্রভাবগুলো যথাযথভাবে পরিমাপ করা প্রয়োজন। যেকোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার পর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের দিক থেকে গৃহীত কর্মসূচিগুলোর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বাজেট নির্ধারণ করে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতে পারে, কিন্তু তার প্রভাব আশানুরূপ না-ও হতে পারে।

প্রায়ই সামাজিক নিরাপত্তাকৌশল গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সম্পদের ঘাটতির কথা বলা হয়। সত্যি কথা বলতে, কোনো দেশেই তার চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত সম্পদ নেই। কিন্তু প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আরও বেশি ইতিবাচক ফল নিয়ে আসা সম্ভব। সম্পদের যথাযথ ব্যবহারকে তাই গুরুত্ব দিতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের মাত্র ৮ শতাংশ শিশুরা পায় িকন্তু এরা জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ। এখানে আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটের ১৩-২০ শতাংশ শিশুর জন্য বরাদ্দ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যায়। সম্পদের ঘাটতি এখানে মূল প্রশ্ন নয়। বরং বিদ্যমান সম্পদের পুনর্বণ্টন করা প্রয়োজন।

কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ
কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ

কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ

আলোচনায় এসেছে, শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে শিশুর উন্নয়নকে ভাবলে চলবে না। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া শিশুর উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না হলে তার শিশুদের স্কুলে দিতে পারবে না। তাদের মেধা বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টির ব্যবস্থা করতে পারবে না। বাসার পরিবেশও শিশুর উন্নয়নের সঙ্গে মানানসই হবে না। শিশুরা স্কুলে না গিয়ে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাৎপর্যপূর্ণ।

আবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল শিশু যথাযথভাবে বিকশিত না-ও হতে পারে। সচ্ছল পরিবারের শিশুরা দায়িত্বশীল না হয়ে বড় হতে পারে। এ জন্য মা-বাবাকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ও যত্নবান হতে হবে।

দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বাধ্য হয়ে শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়। কলকারখানার মালিকদের তাদের প্রতি মানবিক হওয়া প্রয়োজন। শিশুর বিকাশের সঙ্গে জড়িত আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান আইনকে যুগোপযোগী করাসহ প্রয়োজন হলে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমানে শিশু আইন, শিশুশ্রম নীতিমালা কিংবা শ্রম আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। শিশুদের কথা শুনে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে হবে।

মোস্তফা কে মুজেরী
মোস্তফা কে মুজেরী

মোস্তফা কে মুজেরী

শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য এবং শিশুর আয় দারিদ্র্যের মধ্যে সংযোগ থাকলেও এর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। শুধু আয় দিয়ে শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বিবেচনা করা যায় না। আয়ের দিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিবারে লালিত-পালিত শিশুদেরও নানা রকমের দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে হয়। তাই শিশুর আয় দারিদ্র্যের ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে সেটা কার্যকর হবে না।

শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের দুটি দিক—অর্থনৈতিক মাত্রা এবং অ-অর্থনৈতিক মাত্রা। অর্থনৈতিক মাত্রাগুলোর সঙ্গে অ-অর্থনৈতিক মাত্রাগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন শিশু নির্যাতনের বিষয়টিকে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে চলবে না। এর সঙ্গে অ-অর্থনৈতিক অনেক বিষয় জড়িত।

নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিশুর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, শিশুর উন্নয়নের নির্দেশকগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনশীল। সব সময় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও শিশুর সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিতের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেমন শিশুরা শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। কারণ, তার তৎক্ষণাৎ অর্থ প্রয়োজন। তাই অনেক ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিয়ে শিশুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

দারিদ্র্য নিরসন নীতিমালায় দুটি বিষয় গুরুত্ব পেতে পারে—ব্যাপকতা ও তীব্রতা। কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ব্যাপকতা গুরুত্ব দিলে নীতিমালা এক রকম হবে। তীব্রতা গুরুত্ব দিলে নীতিমালা ভিন্ন হবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দারিদ্র্য নিরসন নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভিন্নতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, অঞ্চলভেদে দারিদ্র্যের ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। পাশাপাশি শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন।

হোসেন জিল্লুর রহমান
হোসেন জিল্লুর রহমান

হোসেন জিল্লুর রহমান

বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে আয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে বিস্তর পরিসরে দেখা হয়েছে। তবে সূচকগুলো ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক। কিন্তু শিশুদের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক সূচকগুলো ছাড়াও সামাজিক পরিবেশগত সূচক থাকা প্রয়োজন, যা না থাকলে শিশুর দারিদ্র্যের বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে বোঝা যাবে না। যেমন শিশুর প্রতি সহিংসতা বুঝতে হলে সামাজিক পরিবেশগত সূচক দরকার।

শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনের পদক্ষেপ এমনভাবে নিতে হবে, যেন গৃহীত পদক্ষেপগুলো আবার নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি না করে। শিশুদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাকে পণ্য হিসেবে চিন্তা না করে তাকে বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিশুকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সামাজিকভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। শিশুর ওপর আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কারণে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় শুরু থেকে গ্রাম ও নগরকে বিবেচনায় নিয়ে আলাদাভাবে কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, নগরের বাস্তবতা এবং নাগরিক প্রেক্ষাপটে শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের চ্যালেঞ্জগুলো গ্রামের চেয়ে অধিকতর জটিল।

শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনকে তিনটি পর্যায়ে বিবেচনা করতে হবে—পারিবারিক পর্যায়, কমিউনিটি পর্যায় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়। রাষ্ট্র শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরাসরি কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। যেমন অর্থের বিনিয়োগ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা, যা ব্যক্তি কিংবা পরিবারকেন্দ্রিক নয়। সর্বোপরি শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। কিছু তথ্যের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিশেষ করে, ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক তথ্যের ওপর। কিন্তু তারপরও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন নাগরিক প্রেক্ষাপটে পরিবারের সংজ্ঞা নির্ধারণ জটিল বিষয়। সুতরাং, গুণগত গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনে অ-অর্থনৈতিক মাত্রাগুলোর ক্ষেত্রে গুণগত গবেষণা তাৎপর্যপূর্ণ।

এ এস এম আবদুর রহিম
এ এস এম আবদুর রহিম

এ এস এম আবদুর রহিম

বাংলাদেশ সরকার প্রতিটি উদ্যোগে শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এসব কর্মসূচি হয়তো যথেষ্ট নয়, আরও বেশি কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলো সরকারের সঙ্গে মিলে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি কার্যক্রমগুলোর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে।

শামসুল আলম

বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক িডভিডেন্ড) সময় ২০৩৬ থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এর বিপরীতে নির্ভরশীল জনগণের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ ৭ শতাংশ। পৃথিবীর অনেক দেশে ১৮-২০ শতাংশ নির্ভরশীল জনসংখ্যা রয়েছে। যেমন জাপানে নির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ ১৮ শতাংশ। আজকের শিশুদের ভবিষ্যতে নির্ভরশীল জনসংখ্যার দায়িত্ব নিতে হবে। অধিকসংখ্যক নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে সহযোগিতার জন্য তাদের সামাজিক সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। এ কারণে শিশুদের যথাযথ শারীরিক, মানসিক ও আবেগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিশুর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিবেচনা করা জরুরি।

বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা আনন্দদায়ক না হয়ে ভীতিকর হলে শিশুর মানসিক বিকাশ যথাযথভাবে হবে না। বিদ্যালয়গুলোতে শারীরিক নির্যাতন এখন আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও নির্যাতন রয়ে গেছে। পরীক্ষা–পদ্ধতি শিশুদের অন্যতম ভয়ের কারণ। এত পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর মানসিক ও দৈহিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। শিশু খেলাধুলা, নাচ-গানের সময় পায় না। স্কুলগুলোর পরিবেশ আনন্দময় করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অবশ্যই একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। শিশুকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে সামগ্রিকভাবে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যা শুধু আয় বাড়িয়ে সম্ভব নয়।

আব্দুল কাইয়ুম: পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সাধারণত শিশুদের কথায় কেউ গুরুত্ব দেন না। ধরে নেওয়া হয়, ওরা কী বোঝে। এটাও শিশুর দারিদ্রে্যর একটি দিক। শিশুর দারিদ্র্যকে শুধু আয়ের ভিত্তিতে বিবেচনা করলে হবে না। এটাকে দেখতে হবে বহুমাত্রিকতার প্রেক্ষাপটে।

অসচ্ছল পরিবারের শিশুরা অর্থনৈতিক কারণে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আবার সচ্ছল পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে মানসিক দারিদ্র্য অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। শিশুর দারিদ্র্য পরিমাপের সময় এসব িবষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

যাঁরা অংশ নিলেন

শামসুল আলম: সদস্য (সিনিয়র সচিব) সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন

হোসেন জিল্লুর রহমান: সভাপতি, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)

মোস্তফা কে মুজেরী: নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট

ফাহমিদা খাতুন: প্রধান গবেষক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও পরিচালক, গবেষণা

এ এস এম আবদুর রহিম: প্রধান, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন

মো. মনিরুল ইসলাম: উপপ্রধান, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন

কাজী সাইফুদ্দীন আহমদ: শ্রম উপদেষ্টা, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

রোকেয়া কবীর: এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, নারী প্রগতি সংঘ

লায়লা খন্দকার: পরিচালক, শিশু সুরক্ষা, সেভ দ্য চিলড্রেন

কার্লোস অকাসটা: চিফ, সোশ্যাল পলিসি, ইভালুয়েশন, অ্যানালিটিক অ্যান্ড রিসার্চ, ইউনিসেফ

হাসিনা বেগম: সামাজিক নীতি বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

গওহার নঈম ওয়ারা: উপদেষ্টা, প্রথম আলো