দেখুন তো আপনার সঙ্গে মেলে কি না

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। এটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ কী, জানেন? এটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে পুলিশ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে ব্যাকপ্যাক নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে যেতে পারবেন না।

আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে আমাদের কারও ব্যাকপ্যাক ছিল না। ১৯৭৮ সালে আমি পড়তাম ক্লাস এইটে, রংপুর জিলা স্কুলে। সেই সময় আমাদের কী ছিল, কী করতাম আমরা, তা-ই বলছি। আমাদের সময়ে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁরা মিলিয়ে দেখতে পারেন আপনাদের অভিজ্ঞতা আমারটার সঙ্গে মিলে যায় কি না।

১. হেঁটে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। কোনো ব্যাগ ছিল না। বইখাতাগুলো এক হাতে পেটের সঙ্গে ঠেকিয়ে স্কুলে যেতাম। সারা রাস্তা হাতের ঘামে নিচের লম্বা খাতাটা ভিজে যেত।

২. আমরা বাঁধাই করা খাতা কিনতাম না। দিস্তা ধরে কাগজ কিনতাম। কাগজ লাল-সাদা মোটা সুতা দিয়ে নিজেরা সেলাই করে খাতা বানাতাম। খাতা সেলাই করার জন্য একটা মোটা ভোঁর ছিল। সেটাকে আমরা রংপুরে ভোঁর বলতাম।

৩. রংপুর জিলা স্কুলে আগে ইউনিফর্ম ছিল সাদা পায়জামা, মুগ ডালের রঙের হাওয়াই শার্ট। আমার বড় ভাই এটা পরেই স্কুলে যেতেন। ১৯৭৬ সালে আমি যখন সিক্সে জিলা স্কুলে ভর্তি হলাম, তখন ড্রেস করা হলো, খাকি প্যান্ট সাদা শার্ট। প্যান্ট সবাই বানাতে পারবে না বলে স্কুলে বিদ্রোহ দেখা দিল। স্যাররা জুলুম করে এই ড্রেস বাধ্যতামূলক করলেন। প্রতি ক্লাসে চার-পাঁচজনকে চাঁদা দিয়ে ড্রেস বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ক্লাসের ৬০ জন ছাত্রের মধ্যে দুজন জুতা, ১০ জন স্যান্ডেল শু পরত, অন্যরা পরত স্পঞ্জের চপ্পল। প্রাইমারিতে খালি পায়েও স্কুলে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। স্কুলের ওই প্যান্টই ছিল আমার একমাত্র প্যান্ট।

৪. আমরা প্রাইমারি স্কুলে কোনো দিন টিফিন নিয়ে যেতাম না, টিফিন দেওয়াও হতো না। পিপাসা পেলে বুক দিয়ে টিউবওয়েলের হাতল চেপে কলের মুখে হাত চেপে ধরে পেট ভরে পানি খেতাম। জিলা স্কুলে টিফিনের মাসিক চাঁদা ছিল ৩ টাকা। এর বাইরে ফুল ফ্রি আর স্কলারশিপের ফ্রি টিউশনির সুযোগ ছিল। নইলে আরও ৮-১০ টাকা বেতন দিতে হতো।

৫. প্রাইমারি স্কুলে পেশাব পেলে আমরা স্কুলভবনের পেছনে দেয়ালের ধারে বসে পড়তাম।

৬. দাঁত মাজতাম কয়লা দিয়ে।

৭. ভিসিআর নামের একটা জিনিস এসেছিল। ভিসিআর ভাড়া করে কারও বাড়িতে এনে হিন্দি ছবি চাঁদা দিয়ে দেখা হতো, আমি একটা দেখেছিলাম, তাতে মিঠুন চক্রবর্তী গান গেয়েছিলেন (ও নেচেছিলেন) ‘আই অ্যাম এ ডিসকো ড্যান্সার’।

৮. কারোরই টেলিফোন ছিল না। টেলিভিশন উপকেন্দ্র রংপুরে গেছেই ১৯৭৮ সালে, কাজেই তার আগে টেলিভিশন দেখার প্রশ্নই আসে না।

৯. বাসায় অতিথি এলে আমরা দোকান থেকে কিনে আনা ছোট ছোট গোল গোল বিস্কুট আর চানাচুর খেতে দিতাম। মেহমান বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্কুট ও চানাচুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কোনো কারণে মেহমান আবার ফিরে এলে দেখতে পেতেন, এতক্ষণ যে শিষ্ট বালকদের বারবার অনুরোধ-উপরোধ করেও খাওয়ানো যাচ্ছিল না, আসলে তারা ততটা সুবোধ নয়, কিংবা ক্ষুধামান্দ্যেও ভুগছে না।
বন্ধু জাকারিয়া একটা গল্প বলে। মেহমানের সামনে বিস্কুট দেওয়া হয়েছে। ঘরের শিশুটা খেতে চাইলে মা বলেছেন, উনি তো আর সব খাবেন না, উনি চলে গেলে খেয়ো। কিন্তু মেহমান সব খেয়ে ফেলছেন দেখে শিশুটা বলে উঠল, ‘সবটাই তো খাইয়া ফেলল!’

১০. ছোট ভাই বা বোন কোনো দিন নতুন বই, নতুন কাপড় পেত না। বড় ভাইবোনের পুরোনো কাপড় ও বই তাদের পরতে/পড়তে হতো।

১১. আমাদের শহরে দুই ধরনের রেশনের দোকান ছিল। সরকারি কর্মচারীদের রেশনের দোকান আর জনসাধারণের রেশনের দোকান। ডিলার থাকতেন। রেশনের কার্ড থাকত। সেই কার্ডে প্রতি পক্ষে পরিবারের জনসংখ্যা অনুযায়ী এক-আধসের চিনি বা তেল পাওয়া যেত কিছুটা কম দামে। গম পাওয়া যেত। আমরা আধা বস্তা গম সাইকেলের চেন কভারের ওপরে ফেলে ঠেলে ঠেলে বাড়ি ফিরতাম। তারপর সেটা একই কায়দায় নিতাম আটা ভাঙানোর মিলে।

১২. রেডক্রস থেকে গুঁড়া দুধ আর সয়া বিস্কুট আসত স্কুলে। আমরা মাঝেমধ্যে পেতাম। গুঁড়া দুধ দলা দলা হয়ে থাকত। আমরা সেই দুধ হাতে নিয়ে জিব দিয়ে চেটে খেতাম। তালুতে দুধ আটকে যেত।

১৩. আমাদের চপ্পল ছিঁড়ে গেলে মুচির কাছে নিয়ে গিয়ে সেলাই করে আনতাম। কখনো বা ল্যাম্পের আগুনে ধরে রাবার গলিয়ে নিজেরাই সারাতাম। আবার কখনো নিজেরাই দুটি ছোট পেরেক বা আলপিন মেরে নিয়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল মেরামত করতাম।

১৪. আমাদের মায়েরা, বড় বোনেরা আমাদের শার্ট-প্যান্ট বানিয়ে দিতেন। মেয়েদের জামা অবধারিতভাবে বাড়িতে সেলাই করা হতো।

১৫. আমাদের বাইরের ঘরে চৌকির নিচে পেঁয়াজ থাকত, আলু থাকত।

১৬. খুদ ফেলা হতো না। কাজেই খুদের পায়েস, খুদের জাউ, খুদের বিরিয়ানি, বউখুদি-নানা ধরনের গালভারী নামের খাবার আমাদের মাঝেমধ্যেই খেতে হতো।

১৬. আমাদের কলমের পেটে কালি ভরতে হতো। কালির দোয়াত কেনা আমাদের একটা কাজ ছিল। তবে সবার লেখাপড়া শুরু হতো স্লেট-পেনসিলে।

১৭. আমাদের অনেক বাচ্চাই মাথায় সর্ষের তেল মাখত। শ্যাম্পু জিনিসটা আমাদের শৈশবে ছিল না। তিব্বত সাবান ব্যবহার করলেও প্রতিবেশীরা ঈর্ষা করত।

১৮. আমাদের শৈশবে ৫ পয়সায় সিঙ্গেল পাঁপড়, ১০ পয়সায় ডাবল পাঁপড়, ১০ পয়সায় লাল রঙের আইসক্রিম, সিকিতে দুধমালাই আইসক্রিম পাওয়া যেত।

১৯. আমাদের দাঁতে ব্যথা হলে বলত পোকা ধরেছে। গুনিন আনা হতো। আশ্চর্য যে কী এক শিকড় দাঁতে ধরার পর দাঁত থেকে কিলবিল করে পোকা বেরোত এবং গুনিনের হাতের কচুপাতা ভরে যেত।

যাক, যে কথা বলছিলাম, আমাদের ছোটবেলায় আমাদের ব্যাকপ্যাক ছিল না। তবে আমাদের ব্যাক ছিল। স্যাররা বেতের ব্যবহার করতেন সেই ব্যাকে।

তবে ব্যাকবোনও আমাদের ছিল। এরশাদ সাহেব এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।

এখন ব্যাকপ্যাক আছে, ব্যাক নাই। ব্যাকবোন আছে কি না, সেটা আমি বলতে পারব না।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক