কৃষ্ণ দিবস ২৪

কয়েক দিন আগে টেলিভিশনে খবরটি শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁর ক্ষমতারোহণের বার্ষিকী উপলক্ষে ২৪ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা আহ্বান করেছেন। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় জনসভা ডাকতে পারেন। কিন্তু তাই বলে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দিনটি ঘটা করে উদ্যাপন করবেন? সারা দেশ থেকে লোক নিয়ে এসে ঢাকা শহরে উল্লাস করবেন। আমরা যদি সংবিধান মানি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানি, বলতে হবে এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এ জন্য তো তাঁর লজ্জিত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি লজ্জিত হননি। স্বৈরশাসকদের লজ্জা থাকতে নেই!

এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জাতীয় পার্টির প্রধান বলেছিলেন, ২৪ মার্চ তিনি ক্ষমতা নিতে চাননি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার নাকি স্বেচ্ছায় তাঁর হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠিটি তুলে দিয়েছিলেন। আর সেদিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এরশাদ সাহেব ওয়াদা করেছিলেন, তিনি সৈনিক, রাজনীতি করার কোনো খায়েশ তাঁর নেই। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলেই ব্যারাকে ফিরে যাবেন। কিন্তু পূর্বসূরি জিয়ার মতো তিনিও ব্যারাকে ফিরে যাননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঝগড়া লাগিয়েই এরশাদ নিজের ক্ষমতা নয় বছর স্থায়ী করতে পেরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া স্বৈরাচারকে হটানোর বিষয়ে একমত হলেন, তখন এই সাবেক স্বৈরশাসক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সে সময় দেশ ছাড়ার কথাও ভেবেছিলেন।

আর কোনো দেশে গণ-আন্দোলনে কোনো স্বৈরশাসকেরা পদচ্যুত হওয়ার পর ফের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন, তার উদাহরণ নেই। আমাদের ‘গণতান্ত্রিক’ দলগুলোর দুর্বলতার কারণে এরশাদ রাজনীতিতে জেঁকে বসেছেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসন থেকে তাঁর শাসন অনেক ভালো ছিল বলে আস্ফালনও করছেন। এই বাংলাদেশে সবই সম্ভব।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকগুলো কৃষ্ণ দিবস আছে। ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনে কৃষ্ণতম দিন। এদিন সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ২৪ ও ২৫ মার্চ পাশাপাশি দুটি তারিখ। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরীহ ও নিরপরাধ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। সে কারণে ২৫ মার্চ কৃষ্ণ দিবস। আর বাংলাদেশ আমলে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ মানুষ হত্যা না করলেও সংবিধান হত্যা করে নির্বাচিত বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। অবশ্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বেশ আগে থেকেই। ১৯৮১ সালের শেষে জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদের ডেকে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেছিলেন, স্বাধীন দেশে সেনাবাহিনীর কাজ শুধু দেশরক্ষা নয়। দেশের উন্নয়নেও তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকতে হবে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে এরশাদ সেসব প্রতিশ্রুতি ভুলে বিভিন্ন দল থেকে আসা দলছুটদের নিয়ে প্রথমে জনদল ও পরে জাতীয় পার্টি গঠন করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন।

এরশাদের সৃষ্ট দ্বিতীয় কৃষ্ণ দিবস হলো ২৪ জানুয়ারি। ১৯৮৮ সালের এই দিনে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার জনসভায় আসা মানুষের ওপর গুলি করে ২২ জনকে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন খেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, হোটেল কর্মচারী জিকে চৌধুরী, ছাত্র মহিউদ্দিন শামিম, বদরুল, শেখ মোহাম্মদ, সাজ্জাদ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন, আলবার্ট গোমেজ, আবদুল মান্নান, কাশেম, ডিকে দাস, কুদ্দুস, পঙ্কজ বৈদ্য, চান মিঞা, হাসান, সমর দত্ত, পলাশ, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন ও শাহাদাত হোসেন।

বিএনপি আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টও শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আইভি রহমানসহ ২২ জন মানুষকে খুন করেছিল জঙ্গিগোষ্ঠী। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলা এখন বিচারাধীন। হয়তো চলতি বছরেই বিচারিক আদালতের রায় পাওয়া যাবে। কিন্তু তারও ১৬ বছর আগে সংঘটিত চট্টগ্রাম ‘গণহত্যার’ বিচার অজ্ঞাত কারণে থমকে আছে।

এরশাদের বিরুদ্ধে কেবল রাজনৈতিক দলের নেতারাই আন্দোলন করেননি। রাস্তায় নেমেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ২০ নভেম্বর আন্দোলনরত তিন জোট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থী ৫-দলীয় জোট গণতন্ত্র উত্তরণে যে রূপরেখা দিয়েছিল, তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনন্য দলিল হয়ে আছে। এই দলিলে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন রহিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারগুলো সেসব রহিত না করে গণস্বার্থবিরোধী নতুন আইন জারি করেছে।

আর তিন জোট ঘোষিত আচরণবিধিতে ‘স্বৈরাচারের চিহ্নিত সহযোগী ও অস্ত্রধারীদের’ দলে না নেওয়ার যে অঙ্গীকার ছিল, তাও মানেনি। এখন সাবেক স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার। আর স্বৈরাচারের চিহ্নিত সহযোগীরাও দুই দল ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এক পক্ষে আছেন সাবেক স্বৈরাচার, অপর পক্ষে সেই সাবেক স্বৈরাচারের উপরাষ্ট্রপতি।

সরকারের দোসর বলে আজ এরশাদ সাড়ম্বরে তাঁর অবৈধ ক্ষমতা দখলের দিবসটি উদ্যাপন করতে পারছেন। কিন্তু একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখব আওয়ামী লীগ নিজেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী বলে দাবি করছে। ১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে লিখেছেন, ‘২৪ মার্চ ১৯৮২, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন।...২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক জনগণের পক্ষ থেকে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং এরশাদ শাহীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দৃঢ় শপথ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসেই আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে খ্যাত ১৫-দলীয় ঐক্যজোট।’

সেদিন যাঁর বিরুদ্ধে ১৫-দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল এবং যাঁরা গঠন করেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ আজ এক কাতারে। সেদিন আওয়ামী লীগ এরশাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করলেও এখন তাঁর সাধু পরামর্শ ছাড়া চলতে পারে না। স্বৈরাচারের পরামর্শে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা চলছে।

এত দিন এরশাদের জাতীয় পার্টি ৬ ডিসেম্বর ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দিনটিকে পালন করত যথাক্রমে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ ও ‘গণতন্ত্র উদ্ধার দিবস হিসেবে।’ ভবিষ্যতে হয়তো জাতীয় পার্টি ২৪ মার্চকেই গণতন্ত্র দিবস হিসেবে উদ্যাপন করবে এবং তাতে মহাজোটের প্রধান শরিক দলটিরও সায় থাকবে।

কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী নয় বছরের আন্দোলনে কাঞ্চন, জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, দিপালী ও ফারুক, সেলিম, দেলোয়ার, নূর হোসেন, রাউফুন বসুনিয়া, তাজুল, ময়েজউদ্দিন, ডা. মিলনসহ যে অসংখ্য নেতা-কর্মী ও ছাত্র-তরুণ জীবন দিয়েছেন, তাঁদের কাছে কী জবাব দেবেন গণতন্ত্রের অধিনায়কেরা?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com