উন্নয়ন কি নির্বাচন জয়ের গ্যারান্টি?

গণতন্ত্রে বিরোধী দলের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে থেকে কোনো ক্ষমতাসীন দল সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় জয়লাভের স্বপ্ন দেখবে না। প্রচার-প্রচারণায়ও তার ষোলো আনা অধিকার আছে। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতো করে কেউ সম্ভাব্য বিজয়কে ‘আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র হিসেবে উল্লেখ করতে পারেন, তা কল্পনা করাও কঠিন। যদিও পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু কৃত্রিম উপগ্রহের মতো মেগা প্রকল্প এবং বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও সরকারকে সাধুবাদ জানাই।

তবে শুধু সাফল্য ও উন্নয়নই সংসদীয় গণতন্ত্রে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য যে যথেষ্ট নয়, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতে উইনস্টন চার্চিল হেরে যাবেন, তা অনেকেরই কল্পনায় ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়ালেও ভারতের কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কয়েক বছরের মাথায় পরাজয়ের গ্লানি কবুল করতে হয়েছিল। হাল আমলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যিই জিতে যাবেন, তা অনেকের ধারণার বাইরে ছিল। ফ্রান্সে তরুণ এমানুয়েল মাখোঁ এভাবে জয় পেতে পারেন, তাতে কম বিস্ময় তৈরি হয়নি। এভাবে উন্নত কি অনুন্নত, সাধারণ নির্বাচন অবাধ হতে দিলে তার ফলাফল কী হতে পারে, তা আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। দুর্নীতি না করা ও সুশাসন দিতে সংকল্পবদ্ধ থাকার ভাবমূর্তি নিয়েও ত্রিপুরার মানিক সরকারকে ‘লাল দুর্গের’ পতন প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।
চীন ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনী পরিবেশ দেখে ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতা কোনোভাবে প্রভাবান্বিত হলে অবাক হব না। আবার রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর বলেও একটা কথা আছে, তার ওপর সেটা যদি নির্বাচনী বছর হয়, তাহলে তা আরেক কাঠি সরেস। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসনের কারাদণ্ডের পর আন্তর্জাতিক বিশ্বে, এমনকি বিএনপি ও তার মিত্ররা অভ্যন্তরীণভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ যদি তার প্রতিপক্ষকে আরও দুর্বল করে দিতে উদ্গ্রীব হয়, তাহলে অবাক হব না। বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র সাধারণত পথের মোড়েই আটকে থাকে।

আমরা একটা সংকট কাটতে না কাটতেই বলি, বাংলাদেশ আবার এক ক্রান্তিকালে; এক যুগসন্ধিক্ষণে। আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে-এটুকু বোঝা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের জন্য যথেষ্ট কি না? শুধু একটি মামুলি সংখ্যাগরিষ্ঠের জয় নিয়ে তারা সন্তুষ্ট থাকবে কি থাকবে না, সেই প্রশ্নও হালকা নয়। পঞ্চম সংসদের মেয়াদে বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখতে না দেখতে মিলিয়ে গেল। নির্বাচনে সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগে অস্বস্তি থাকবে। একতরফা নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ জয়ের স্বাদ যারা পেয়েছে, তারা সেটা সহজে ভুলতে পারবে না। অন্যদিকে বিএনপির জন্য নির্বাচনে বিজয়ের চেয়ে তার সামনে দুটি জ্বলন্ত প্রশ্ন থাকবে। প্রথমত, যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকা। দ্বিতীয়ত, বিএনপি সে জন্য কতটা চড়া মূল্য দিতে রাজি থাকবে? সম্ভবত বিএনপিকে খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বের অবসান স্বীকার করা নাকি তেমনটা মেনেও নির্বাচনে অংশ নিয়ে কিছু সংসদীয় আসন পাওয়ার মতো একটি বাস্তবতার মুখে দাঁড় করানো হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব কি না? স্রেফ বেনজির ভুট্টোর স্বামী হওয়ার সুবাদে আসিফ আলী জারদারির পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং কিশোর বিলাওয়ালের পিপিপি-প্রধান হওয়া, অন্যদিকে ইতালীয় বংশোদ্ভূত সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের বাস্তবতাকে নির্দেশক ধরে নিলে মেনে নিতে হয় যে বাংলাদেশি রাজনীতি থেকেও যত যা-ই ঘটুক, উত্তরাধিকারের রাজনীতিকে মুছে ফেলা সহজ হবে না।

১৯৯০ সালের পতনের পর জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর ফার্স্ট লেডিকে নিয়ে এভাবে ফিরে আসতে পারেন, তা অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল। নয় বছরের একটি তীব্র এবং রক্ত ঝরানো আন্দোলনকে দুই দলই কার্যকরভাবে মূল রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় করেছে। ২৪ মার্চের কালো দিবস উদ্যাপনের বৈপরীত্য তুলে ধরে আওয়ামী লীগকে আমরা ঘায়েল করতে পারিনি। আমরা নূর হোসেন, তাজুল সেলিম-দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়াদের পরিত্যাগ করেছি।

তবে নবতর একটা বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে, যা আগে দেখা যায়নি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মিত্র হিসেবে প্রতীয়মান কর্নেল অলি আহমদের জন্মদিন আগে নীরবে গেছে। আকস্মিকভাবে আমরা জানলাম, খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি সরকারি সফরে ভারতে যাচ্ছেন। ভারতের হাইকমিশনার নতুন করে বলেছেন, ভারত কোনো দল নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।

বিএনপি এখন এর মধ্যেও তাৎপর্য খুঁজবে। চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইতিহাসে এই প্রথম নিজ গরজে সংবাদ সম্মেলন করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে প্রকাশ্যে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। ভারতীয় একটি পত্রিকার এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে পড়েছিলাম, নেপালে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভারতীয় কূটনীতিকেরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজধানীগুলোতে যেভাবে সক্রিয় থেকেছেন, সেই পথে এখন থেকে তাঁদেরও দেখা যাবে। পাস না হওয়া ডিজিটাল আইনের বাকসংকোচন নিয়ে এগারো রাষ্ট্রদূতের নির্দিষ্টভাবে উদ্বেগ প্রকাশও নতুন ঘটনা।

ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমে প্রায় নিয়মিতভাবে ভারতের শুধু একদিকে ঝোঁকার নীতি ঠিক নয় বলে মত দিতে দেখি, আর সেই সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে কোনো সূত্রের উল্লেখ না করে তারা এটাও বলে, ভারত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, সেটা আওয়ামী লীগকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের ভারতীয় চ্যাপ্টারের ফেলো ধ্রুব জয়শঙ্কর গত ২০ ফেব্রুয়ারি লিখেছেন, ‘অনেক ভারতীয় এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে প্রতিবেশীরা ভারতের প্রতি বৈরী। এখন যদি বর্তমানে বিরোধী শিবিরে থাকা শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে, বাংলাদেশের খালেদা জিয়া, নেপালের শের বাহাদুর দিউবা এবং মালদ্বীপের মোহাম্মদ নাশিদ নিজ নিজ দেশে ক্ষমতাসীন হন, তাহলেও অনেক ভাষ্যকার বলবেন যে প্রতিবেশীরা ভারতের প্রতি বৈরী। আর সেটাই নিশ্চিত করে যে অনুরূপ মূল্যায়ন (ভারতের প্রতি কারা বৈরী, কারা বৈরী নয়) আসলে কতটা অর্থহীন।’ এ ধরনের মূল্যায়ন আমরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে দেখিনি।

উন্নয়নশীল দেশ, যাকে বিশেষজ্ঞরা ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে থাকেন, সেখানে সবার জন্য মাঠ সমতলের ধারণায় এটা প্রচ্ছন্ন থাকে যে ক্ষমতাসীন দলই এই পথে বড় হুমকি। তারা যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জয়ী হতে চায়। সে জন্য তারা সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহারের প্রবণতা দেখায় বলেই নির্বাচনকালে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রী-সাংসদদের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি আসুক, সেটা আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের সব মিত্র-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্তত প্রকাশ্যে বলবে, জাতিসংঘসহ অন্যরাও বলবে। এখন জ্বলন্ত প্রশ্ন দুটি-আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিকে দেখতে চাইবে? অন্যদিকে বিএনপি কেন নির্বাচনে আসবে? এটা মীমাংসিত যে বিএনপি গত নির্বাচন বয়কট করায় দলটির জন্যই নয়, দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থারও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং কথিতমতে দল ভাঙাসহ সম্ভাব্য যত বিপর্যয়ই আসুক, বিএনপি যেকোনো বিবেচনায় দ্বিতীয়বার নির্বাচন বয়কট করুক, সেটা আমরা দেখতে চাইব না। বিএনপির উচিত এটা বলা যে তারা আইনি লড়াই চালাবে, তবে তারা অবশ্যই নির্বাচনে যাবে। মুক্তি না দিলে নির্বাচন বয়কটের হুমকি আত্মঘাতী এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনবিনাশী।

আমরা চাইব, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আন্তরিক থাকুক, আনুষ্ঠানিক সংলাপ অপরিহার্য নয়। একতরফা নির্বাচনে সংসদ হলে গোটা রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা যাতে কার্যকর ও অর্থবহ এবং বিশ্বের মর্যাদা কুড়ায়, সে জন্যও আমাদের একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]