বিএনপি কেন জনসভা করতে পারবে না?

Masuk_Art_30_03_2018
Masuk_Art_30_03_2018

জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ   

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এ কারণে যে বিলম্বে হলেও তিনি অনুধাবন করেছেন, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি কিংবা অন্যান্য দলকে ঢাকায় জনসভা করার অনুমতি দিলে বিএনপিকেও দেওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, ২৯ মার্চ বিএনপিকে জনসভা করতে না দেওয়ার অর্থ এই নয় যে আর কখনো দেওয়া হবে না।

আমরাও আশা করতে চাই বিএনপি শিগগিরই ঢাকায় জনসভা করার অনুমতি পাবে। তবে ঢাকায় জনসভা আহ্বানকারী সব রাজনৈতিক দলের কাছে অনুরোধ থাকবে, তারা যেন সপ্তাহের কর্মদিবসে জনসভা না করে। যে শহরে ছুটির দিনেও যানজট লেগে থাকে, সেই শহরে কর্মদিবসে জনসভা করলে শুধু জনজীবন নিশ্চল হয়ে পড়ে না, লাখ লাখ নারী-পুরুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় হাসপাতালগামী রোগী ও স্কুলগামী শিশুদের। জনগণের মঙ্গলের জন্য রাজনীতি করা কোনো দল জেনেশুনে এভাবে মানুষকে মহা দুর্ভোগে ফেলতে পারে, ভাবতেও কষ্ট হয়।

 ঢাকা শহরে জনসভা করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। পল্টন ময়দানজুড়ে এখন স্টেডিয়ামসহ নানা স্থাপনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নির্মাণ করা হয়েছিল রমনার সবুজ বেষ্টনী বাড়িয়ে নগরবাসীকে একটু স্বস্তি দিতে। তদুপরি এখানে স্থাপন করা হয়েছে স্বাধীনতাস্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন। এর গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য রক্ষা করতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা না হওয়াই ভালো। একসময় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জনসভা হতো—তার মাঝখানে ডিভাইডার তৈরি করে বিভক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে কিংবা নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে জনসভা করা মানে পুরো শহরকে অচল করে দেওয়া।

 তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) যখন মানুষের এসব কষ্ট ও বিড়ম্বনা উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ, জোট শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকে ‘চাহিবামাত্র’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার অনুমতি দিচ্ছে, তখন বিএনপিকে কেন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে? বিএনপির জন্য জনসভা করা বারণ—সে রকম কোনো বিধান নিশ্চয়ই ডিএমপির কার্যবিধিতে নেই।

 আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে বিএনপির নেতারা একটি জনসভার জন্য ডিএমপির অফিসে ধরনা দেবেন। আবার বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের নেতারা একই কায়দায় সেখানে ছোটাছুটি করবেন—এটি রাজনীতি ও রাজনীতিকদের জন্য সম্মানজনক নয়। বিএনপির নেতারা এখন দৌড়ের ওপর আছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে। তাঁর মাথার ওপর আরও অনেকগুলো মামলার খড়্গ আছে। মামলা আছে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীর নামে। ফলে তাঁরা নির্বাচনী মাঠে নামতেই পারছেন না। তবে বিএনপি নিজেদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে না পারলেও ধারণা করি, আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের অপূর্ণ কাজটি করে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বক্তৃতা শুরু করেন বিএনপি দিয়ে, শেষও করেন বিএনপি দিয়ে। নির্বাচনী প্রচারে সাধারণত ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের সাফল্য ও দেশের উন্নয়ন নিয়েই বেশি কথা বলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি নিয়ে মঞ্চ গরম করতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। হয়তো নিজেদের পক্ষে বলার মতো কোনো কথা নেই।

আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন—নির্বাচন কমিশনের বিধিমালায় এ ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না, আমরা জানি না। তবে সোজা কথায় বুঝি, একটি দল জনসভা করে ভোট চাইলে অন্যদেরও সেই সুযোগ দিতে হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দশ কথার এক কথা বলেছেন। বিএনপিকে নিয়ে নাকি সরকার খুব বেকায়দায় আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কায়দা-বেকায়দার ফারাকটি খুবই সূক্ষ্ম। আজ আওয়ামী লীগের জন্য যেটি কায়দা এবং বিএনপির জন্য বেকায়দা, সেটিই আগামীকাল বিএনপির জন্য কায়দা এবং আওয়ামী লীগের জন্য বেকায়দা হতে পারে। বিএনপির কোনো এক নেতা বলেছিলেন, সরকার জনসভার অনুমতি দিতে বাধ্য হবে। সেই কথার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিএনপি কী এমন মহাপ্লাবন এনেছে যে সরকার অনুমতি দিতে বাধ্য হবে? তাহলে কি আওয়ামী লীগ চায় দেশে আরেকটি মহাপ্লাবন আসুক?

আওয়ামী লীগের নেতাদের এখনকার বক্তৃতা-বিবৃতির সঙ্গে ২০০৫-০৬ সাল কিংবা তারও আগে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচন, সংবিধান, সংসদ ইত্যাদি বিষয়ে তখন বিএনপির নেতারা যেসব কথা বলতেন, আজ আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায় একই ভাষায়, একই ভঙ্গিতে সেসব কথাই বলছেন। অর্থাৎ  সংবিধানকে দুই দলই নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন।

গণতন্ত্রে এমন কতগুলো বিষয় আছে, যা শাশ্বত। যেমন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা। সব গণতান্ত্রিক দেশ এই নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু আমাদের দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রের ও ভোটের সংজ্ঞা তৈরি করে। অতীতে আইয়ুব খানসহ অনেকেই নিজের সুবিধামতো গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টালেও শেষ বিচারে সুবিধা করতে পারেননি। বাংলাদেশেও দুই সামরিক শাসক গণতন্ত্র নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। দিনের শেষে তাঁরা কেউ নিজেদের গণতন্ত্রী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।

ওবায়দুল কাদের যে বেকায়দার কথা বলেছেন, সেটি আসলে বিএনপিকে নিয়ে নয়, গণতন্ত্রকে নিয়ে সরকার বেকায়দায় আছে। কেননা, গণতন্ত্র থাকলে গণতন্ত্রের নিয়মগুলোও সরকারকে মেনে চলতে হয়। গণতন্ত্র থাকলেই পক্ষ–বিপক্ষ থাকে। গণতন্ত্র না থাকলে চীনের মতো একদলের শাসন এবং আজীবন একজনকে প্রেসিডেন্ট বানানো যায়। গণতন্ত্র নিয়ে সরকার যে এখন বেকায়দায় আছে, সেটি কীভাবে তারা কায়দায় নিয়ে আসে, তার ওপরই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই কায়দার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা। আশা করি, আওয়ামী লীগের নেতারা আরেকবার ১৯৯৫-৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখবেন।

গণতন্ত্রের অবনমনের জন্য আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এবং বিএনপি আওয়ামী লীগকে দায়ী করতে পারে। কিন্তু জনগণ তো কোনো দোষ করেনি। সংবিধান অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ আওয়ামী লীগের যে নেতারা শহীদদের রক্তস্নাত সংবিধান রচনা ও  সমুন্নত রাখার কৃতিত্ব দাবি করেন, তাঁরা কী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন সেই সংবিধানে বিধৃত গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি পুরোপুরি মেনে চলছেন? মানলে সবার আগে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার স্বীকার করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপি আমলে বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন যদি না–হক হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগ আমলে একই কাজ হক হতে পারে না।

বিএনপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল হরতাল-অবরোধের নামে সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও করেছে, বাসে, ট্রেনে, সরকারি স্থাপনায় হামলা করেছে। কিন্তু তিন বছর ধরে যখন দলটি হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের ভাষায় জনসভা ও মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচি পালন করছে, তখন কেন সরকার তাতে বাধা দিচ্ছে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি