নারী নির্যাতন প্রতিরোধে জবাবদিহি বাড়াতে হবে

প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে আইনের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও নির্যাতন বাড়ছেই। আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও পদক্ষেপ নিলে নারী নির্যাতনের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি বাড়াতে হবে।

শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি) সহায়তায়। সংস্থাটির পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজনে সহায়তা করে। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

আইআইডির নির্বাহী প্রধান সাঈদ আহমেদ বলেন, আইআইডি গত পাঁচ বছর ধরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করছে। তিনি জানান, নারী নির্যাতনের বিষয়ে মাঠ পর্যায় থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা হচ্ছে। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে।

আলোচনায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন, মাদকের বিস্তার, মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে নারী নির্যাতন বাড়ছে। এই কারণগুলোকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তিনি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এলাকা ভিত্তিক সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা, বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহি বাড়ানো এবং নির্যাতনের ঘটনা গোপন না করে তা প্রকাশ করার সুপারিশ করেন।

মালেকা বানু হতাশা প্রকাশ করে বলেন, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে আন্দোলনের জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভাবে সালিশির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনও চাপের মুখে পড়ছে। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, সমাজে নারী উন্নয়ন বিরোধী শক্তির প্রশ্রয় পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে নারীর ঝুঁকি বাড়ছে।

সহিংসতার শিকার নারী ও শিশু আলোচনায় এলেও অপরাধীরা এ আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, নারী নির্যাতনের কারণগুলোও সেভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়ার পথে যে যাত্রা করেছে তাতে নারী নির্যাতন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সারা হোসেন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন বা কঠোর শাস্তির বিধানের চেয়ে কৌশল ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টিতে জোর দেন। তিনি বলেন, একদিকে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো ভাবে দাঁড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চার নারীর (ধর্ষণের শিকার দুজন এবং দুজনকে অপহরণ করা হয়েছে) কথা উল্লেখ করে বলেন, এই নারীদের পাশে কয়জন দাঁড়াতে পেরেছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন সৈয়দ মো. শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, মুঠোফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেছে পর্নোগ্রাফি। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় সাংস্কৃতিক দল বা কর্মীদের আর দেখা মেলে না। এ সবের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আওয়াজও তোলা হচ্ছে না।

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন না হলে নারীর কণ্ঠস্বর শোনা যাবে না বলে মত দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিয়া হক।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌশলী (পিপি) আলী আসগর স্বপন আক্ষেপ করে বলেন, ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের এখন পর্যন্ত বিধিমালা তৈরি হয়নি। ফলে আইন সংশ্লিষ্টরা একেকজন একেকভাবে আইনটিকে ব্যবহার করছেন। আইন সংশ্লিষ্টরা কোনো গাফিলতি করলে শাস্তির বিধান আছে, হাইকোর্টের রায় আছে, কিন্তু কেউ শাস্তি পেয়েছে আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো নজির নেই। তাই জবাবদিহি বাড়াতে হবে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার হুমায়রা ফারহানাজ বলেন, সরকার বাল্যবিবাহমুক্ত জেলা, উপজেলা ঘোষণার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী এখন চলন্ত মাইক্রোবাস বা নৌকায় বিয়ে পড়ানো হচ্ছে। তাই মানুষের সচেতনতা ও মনমানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। বিভিন্ন আইন ও নীতি বাস্তবায়নে সরকার আসলেই কতটুকু বাজেট বরাদ্দ করছে তাও খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন, নারীর মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি এখন পর্যন্ত উপেক্ষিত। পরিবারের সহায়তার অভাবে নির্যাতনের শিকার নারীরা প্রতিকার পাচ্ছে না। অনেক সময় সন্তান, সংসারের কথা চিন্তা করে নারীরাও আইনি সহায়তা নিতে চাচ্ছেন না।

দি এশিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কারিগরি উপদেষ্টা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, স্মার্ট ফোন এখন সহজলভ্য। কিন্তু এ ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা হয়নি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তিনি যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেন।

আইআইডির সহযোগী গবেষক ফাল্গুনী রেজা সংগঠনের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ এবং মেয়েদের শিক্ষা বিভাগের প্রধান রাফিয়াত রশিদ মিথিলা বলেন, পরিবার থেকেই শিশুকে শেখাতে হবে নারীকে নির্যাতন করা যায় না। শিক্ষা কারিকুলামে ‘সেক্স এডুকেশন’ কে গুরুত্ব না দিলে শিশুরা বিকৃত উপায়ে তা শেখার চেষ্টা করবে। গণমাধ্যমে নারী বিদ্বেষী বক্তব্য যাতে প্রচার না পায় তাও নজরদারির আওতায় আনতে হবে।