পুনরুত্থান রোববার বা ইস্টার সানডে

যিশুর পুনরুত্থান পাপের ওপর বিজয় এনেছে। মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করেছে
যিশুর পুনরুত্থান পাপের ওপর বিজয় এনেছে। মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করেছে

আজ ১ এপ্রিল, রোববার। খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা আজ মহাসমারোহে পালন করছে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান মহোৎসব পাস্কা বা ইস্টার। সবাই উচ্চকণ্ঠে গেয়ে উঠছে: আল্লে­­লুইয়া, অর্থাৎ জয় জয় প্রভুর জয়। গত ২৯ মার্চ ছিল গুড ফ্রাইডে বা পুণ্য শুক্রবার; স্মরণ করা হয়েছে যিশুর পরিত্রাণদায়ী মৃত্যু। মানুষ কৃচ্ছ্রসাধন করে, উপবাস বা রোজা থেকে নিজ পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে; নিজ পাপ স্বীকার করে ঈশ্বর ও মানুষের সঙ্গে হয়েছে পুনর্মিলিত। আজ আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে, পালন করা হচ্ছে প্রভু যিশুর গৌরবময় পুনরুত্থান।

আজ পুনরুত্থান রোববার বা পাস্কা রোববার: হিব্রু ভাষায় পাস্কা মানেই হলো পেরিয়ে যাওয়া বা পার হয়ে যাওয়া। যিশুর পুনরুত্থান পাপের ওপর বিজয় এনেছে। মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করেছে। এই অর্থেই আজকের এই মহোৎসবের নাম পাস্কা। যিশুর পুনরুত্থানে মানুষের জীবনে উষার আলোর উদয় হয়েছে। তাই এই পর্বের নাম ইস্টার।

ইস্টারের বড় মোমবাতি: বস্তুত, শনিবার রাত থেকেই এই নবজীবনের মহোৎসব শুরু হয়। শনিবার রাতে নিস্তার জাগরণী উপাসনায় যিশুর পুনরুত্থান ঘোষণা করা হয় এবং সবাই মেতে ওঠে পুনরুত্থানের আনন্দে। জ্বালানো হয় পুনরুত্থানের প্রদীপ, এক বিরাট আকারের মোমবাতি, যা ঘোষণা করে: যিশুর পুনরুত্থান মানুষের জীবনে এনেছে নতুন আলো, নতুন জীবন; যিশুর পুনরুত্থান দূরীভূত করেছে পাপের অন্ধকার; মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী যিশুখ্রিষ্টের সঙ্গে হয়েছে নবীভূত।

আজকের এই মহোত্সব আলোর মহোত্সব। এই উত্সব আমাদের সবাইকে আলোকিত মানুষ হয়ে যিশুর সঙ্গে পুনরুত্থিত হয়ে তাঁর আলোতে উদ্ভাসিত হতে আহ্বান জানায়। আজ নতুন সাজে ছোট-বড় সবাই পুনরুত্থানের খ্রিষ্টযাগে তথা উপাসনায় অংশগ্রহণ করে।

গির্জাঘর থাকে খ্রিষ্টভক্ত দিয়ে পূর্ণ। উপাসনা বা নামাজের পরেই চলে আপন আপন কৃষ্টিতে ইস্টারের শুভেচ্ছা বিনিময়। ঘরে ঘরে আজ আয়োজন করা হয় দই-চিড়া-মুড়ি-মুড়কির মতো হরেক রকম মুখরোচক আহারসামগ্রী। এতে অংশগ্রহণ করবে ঘরের সবাই, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই। এই আসরে অনেক সময়ই নিমন্ত্রিত হয় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ ভাই-বোনেরাও।

একটি আহ্বান: পুনরুত্থিত বা আলোকিত জীবনের দর্শনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী হতে পারে?: যেখানে বৈষম্য ও দলাদলি থেকে আসে মিলন ও ভ্রাতৃত্ব, যেখানে অশান্তি থেকে আসে শান্তি, যেখানে ঝগড়া-বিবাদ থেকে আসে ক্ষমা, যেখানে জটিলতা ও অস্বাস্থ্যকর জটিলতা-কুটিলতা থেকে আসে সরলতা ও স্বচ্ছতা, যেখানে নেই ধর্ষণ বা মানব নিধন, যেখানে নেই কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি, যেখানে নেই মিথ্যার ছড়াছড়ি, যেখানে নেই সন্ত্রাস ও সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ, সেখানেই তো নবজীবন, পুনরুত্থিত জীবন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমাদের দেশে অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষ ভীষণভাবে নৈতিকতার দিক থেকে অসুস্থ, বলা যায় মৃত। অনেক মানুষই আজ মিথ্যা, চুরি, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ, হানাহানি, খুনোখুনি, পরচর্চা, পরনিন্দা, প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি-এমন সব পাপের গহ্বরে পড়ে আছে। আজকের এই ইস্টার বা পুনরুত্থানপর্ব এমন অন্ধকারের জীবন থেকে বের হয়ে বাংলার মানুষকে আলোর রাজ্যে আসার আহ্বান জানায়।

বাংলার মানুষের বৈশিষ্ট্য: বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই শান্ত; উগ্রতা তার ধর্ম নয়, তার মানায় না। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের মানুষ মিলনের কৃষ্টির মানুষ; হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একত্রে বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরেই। বাংলার মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যায় বিদেশি বন্ধুরা। অতএব, আমাদের শক্তি আছে এই মূল্যবোধগুলো নিয়ে উল্লিখিত পাপগুলোর ওপর জয় করে পুনরুত্থিত মানুষে পরিণত হওয়া। আর এ প্রসঙ্গে যিশুর পুনরুত্থান আমাদের প্রত্যেকের জন্য পাপের ওপর বিজয়ী হওয়ার একটি বড় চেতনা ও প্রেরণা। আর এ প্রসঙ্গেই দেখা যাবে যে এই পাস্কা-পর্ব শুধু খ্রিষ্টবিশ্বাসীদেরই নয়, এই মহোৎসব আবেদন, তাগিদ ও এর আহ্বান সর্বজনীন।

পাস্কা ও বাংলা নববর্ষ: এ বছরের পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল; অর্থাৎ এই পাস্কা বা ইস্টার সানডের দুই সপ্তাহ পরেই। নববর্ষ তো নতুন জীবনই ঘোষণা করে। নতুনকে স্বাগত জানিয়ে সেদিন গেয়ে উঠব: এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। একইভাবে আমরা এই পুনরুত্থান উৎসবে নতুন জীবনকে স্বাগত জানাই। আমাদের জীবন ঘোষণা করুক যে আমরা কথায়, কাজে, আচরণে, সম্পর্কে, ধর্মীয়, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনে হয়েছি নতুন।

ইস্টারে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি: তা প্রকাশ পাবে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। এই পুনরুত্থিত নবজীবনে পরিবারে দেখা যাবে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা; প্রতিটি কাজে সহযোগিতা। পরিবারে থাকবে শান্তি।

গ্রামগঞ্জে, শহরে সবার মধ্যে থাকবে শান্তিশৃঙ্খলা। তা ছাড়া, যুবসমাজের মধ্যে থাকবে যুবনৈতিকতা, জীবন গঠনে দৃঢ়তা, বিদ্যাশিক্ষা, নানাবিধ কল্যাণকর যুব উদ্যোগে থাকবে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ততা আর সৃজনশীলতা। আর এভাবেই প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি ধর্মের মানুষ তথা গোটা বাংলাদেশ নতুন হয়ে উঠবে। আসুন ভাই ও বোনেরা, যিশুর পুনরুত্থান মহোৎসবে আমরা নতুন মানুষে পরিণত হই।

বড় আক্ষেপ: এই আনন্দের দিনেও একটি আক্ষেপ! ইস্টার তথা যিশুর পুনরুত্থান-রহস্য খ্রিষ্টধর্মের একটি প্রধান ধর্মীয় বিষয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের ভিত্তিই হলো যিশুর এই পুনরুত্থান। অন্যান্য ধর্মের প্রধান প্রধান ধর্মীয় আয়োজন, যেমন পূজা বা ঈদ রয়েছে, ইস্টার তেমনি একটি মুখ্য খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় মহোত্সব।

পরিতাপের বিষয়, দিনটি ছুটির দিন নয়। এই দিনটিতে খ্রিষ্টবিশ্বাসীরা মুক্তধারায় মহোত্সবটি পালন করতে পারছে না, কারণ ইস্টারের পরদিনই এইচএসসি পরীক্ষা! দেশের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন, এটি হলো খ্রিষ্টবিশ্বাসী আমাদের সবার বিনম্র অনুরোধ ও ঐকান্তিক প্রত্যাশা।

হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার প্রতি রইল শুভ পাস্কা পর্বের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা। পুনরুত্থিত যিশুর শান্তি ও আনন্দ সবার ঘরে ঘরে বিরাজ করুক। শুভ পাস্কা, শুভ পুনরুত্থান, হ্যাপি ইস্টার!! খ্রিষ্ট সত্যিই পুনরুত্থান করেছেন, আল্লেলুইয়া!!

ফাদার প্যাট্রিক গমেজ: ক্যাথলিক ধর্মযাজক, মুন্ডুমালা ক্যাথলিক মিশন, তানোর-রাজশাহী
আহ্বায়ক, খ্রিষ্টীয় ঐক্য ও আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশন, রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশ