নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা

১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে দ্বিদলীয় রাজনীতির যাত্রা শুরু হলেও আস্থার জায়গাটি তৈরি হয়নি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। সবাই ষড়যন্ত্র খোঁজেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় গেলে দেশের সর্বনাশ হবে-সকাল-সন্ধ্যা এটাই এখন শুনতে হচ্ছে, আগেও আমরা শুনেছি। ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনপদ্ধতিকে অনেক আগেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন। ক্ষমতার রাজনীতিতে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা অস্তাচলে গেছে। এর জায়গায় জন্ম নিয়েছে প্রতিহিংসা ও নির্মূলের রাজনীতি। বড় রাজনৈতিক দল দুটি নানান সুযোগ-সুবিধার ভাগ-বাঁটোয়ারা করে তৈরি করেছে নিজ নিজ বলয়ে অনুগ্রহজীবী বড় একটি শ্রেণি। নিজেদের অর্থবিত্ত-প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনে তাঁরা শয়তানের সঙ্গেও গাঁটছড়া বাঁধতে কসুর করেন না। রাজনীতি থেকে নীতিনৈতিকতা প্রায় নির্বাসনে গেছে।

পারস্পরিক আস্থা না থাকার কারণে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিয়মকে হিমঘরে পাঠিয়ে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মডেল গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার আকাঙ্ক্ষা থেকে এই প্রক্রিয়াটিও পরে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জনমনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে এই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। হঠাৎ করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হোঁচট খায়। ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ বলে রায় দেন।

এই রায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য ছিল বেশ সুবিধাজনক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে প্রবল জনমত থাকা সত্ত্বেও জাতীয় সংসদে একচেটিয়া আধিপত্যের জোরে সরকার এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এর ফলে তৈরি হয় নতুন সংকট। এই ব্যবস্থার পক্ষে একদা আওয়ামী লীগ তুমুল আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিল এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তার সুফল পেয়েছিল। এখন দলটি মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় তাঁদের বিশেষ সুবিধা হবে না। যে চারাগাছটি তাঁরা রোপণ করেছিলেন, সেটি উপড়ে ফেলতে তাঁরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। এদিকে বিএনপি একটি ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আসছে, যা তারা একসময় বিরোধিতা করেছিল। বিএনপির উপলব্ধি হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি ঘোরতর বিপদের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা-এ দুইয়ের দ্বৈরথে দেশ দ্রুত একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।

আমরা যারা অল্পস্বল্প ক্রিকেট খেলি বা খেলা দেখি, আমরা জানি যে ব্যাটে বল লেগে যখন সীমানার দিকে ছুটে যায়, তার গতি এবং মাঠে ফিল্ডারের অবস্থান দেখে ধারাভাষ্যকার আগাম বলে দেন, এটা চার-ছক্কা হবে কিংবা হবে না। তারপরও তাঁকে অনেক সাবধানে পূর্বাভাস দিতে হয়। এ দেশে ব্যাকরণ মেনে রাজনীতি হয় না। এ জন্য সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব এবং বিপজ্জনকও বটে। এখন চারপাশে আমরা ফিসফাস শুনি-কী হতে যাচ্ছে?

বিএনপি সংসদে নেই। সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলো জাতীয় পার্টি। তার অবস্থা অনেকটা সার্কাসের ভালুকের মতো। রিং মাস্টার তাকে যা বলবে, সে তা-ই করবে। তারপরও জীবন্ত ভালুক দেখতে মানুষ টিকিট কেটে সার্কাস দেখতে যায়। বিএনপি সংসদে না থাকলেও তারাই কার্যকরভাবে প্রধান বিরোধী দল। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের শক্তির ভারসাম্যে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আমজনতার চোখে তারা একে অপরের বিকল্প। তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা ধারা জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে নিকট ভবিষ্যতে আসবে বলে মনে হয় না। বামদের অবস্থা তো শোচনীয়, রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদ্যাপনও তারা সবাই মিলে একসঙ্গে করতে পারল না। এটা দুর্ভাগ্যজনক।

নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল। পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের জোরে দলটি এখনো টিকে আছে এবং আওয়ামী লীগের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। এটা আওয়ামী লীগ ভালোই বোঝে এবং সব সময় বিএনপির নাম জপ করে। আওয়ামী নেতারা বিএনপিকে যতই গাল দেন, বিএনপি ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো তারা সুশাসন দিতে পারেনি। অর্থনৈতিক অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও সমাজে অস্থিরতা বেড়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং দেশে সরকারি দলের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নাগরিকেরা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বিকল্পের সন্ধান করতে পারেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা যে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো হবে, সুশাসন নিশ্চিত করবে, তাদের অতীত রেকর্ড দেখে এটা মনে হয় না। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তা মেনে নিতে হয়।

টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমনে যে ক্ষোভ জন্মেছে, ক্ষমতার বাইরে গিয়ে তার মুখোমুখি হতে আওয়ামী লীগ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। সুতরাং আওয়ামী লীগ হারতে চাইবে না। আর যদি একটা ভালো নির্বাচন হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা থেকেই যাবে বলে বিএনপি মনে করে। এমন একটি অবস্থায় যেখানে দুটি দলই জিততে চায় এবং পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা কারও নেই, সেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি আছে আবারও সহিংস রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যাওয়ার। কেউই চায় না তার প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় আসুক।

আমাদের স্মরণ থাকা দরকার যে ২৬ নভেম্বর ২০১৩ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ৪০ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১২৩ জন নিহত হন। জনমনে একটা জিজ্ঞাসা, আমরা কি আবারও এমন একটি অবস্থার মধ্যে পড়ব? একটা কথা মোটামুটি পরিষ্কার, সামনের দিনগুলো সহজ হবে না।

রাজনীতির মাঠে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেশি হলে নানা রকম সমীকরণ তৈরি হয়। বাংলাদেশে দ্বিদলীয় রাজনীতি এমন একটি পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যে দেশ দুই যুযুধান রাজনৈতিক পরাশক্তির থাবার নিচে চলে গেছে। এই মেরুকরণ নাগরিকদের জন্য স্বস্তিকর হয়নি। বড় দুই দলের মধ্যে দ্বৈরথ এখন চরম আকার ধারণ করেছে।

আওয়ামী লীগ আছে চালকের আসনে। অন্যদিকে এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি নানা কারণেই এলোমেলো। দলটির শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা। একটি মামলায় ইতিমধ্যে তিনি নিম্ন আদালতে সাজা পেয়েছেন। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আবার তাঁকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতিমধ্যে বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি একান্তই দলের এবং কেউ না এলেও নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগের অনেক কর্তার গলায়ও এ রকমটি শোনা যায়। অর্থাৎ, সব দলকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হওয়া বা না হওয়ার সম্ভাবনা পেন্ডুলামের কাঁটার মতো দুলছে।

এই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানান জল্পনা, অনিশ্চয়তার ধূম্রজাল।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi [email protected]