দেশের জন্য দায়বোধের ভীষণ অভাব

সন্‌জীদা খাতুন
সন্‌জীদা খাতুন
>আজ সংস্কৃতিজন, ছায়ানটের সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের ৮৫ তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহীদ রেজা নূর

প্রথম আলো: আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ৮৫ বছর পার করে ৮৬তে পড়লেন। যা করতে চেয়েছেন, তার কতটুকু করতে পেরেছেন? 

সন্‌জীদা খাতুন: আমাদের মনে একটা প্রশান্তি ছিল, আমরা বাঙালি সংস্কৃতিটাকে মানুষের মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারি তো আছেই, পয়লা বৈশাখকে অবলম্বন করেই আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার বোধটা, বাঙালির সব ধরনের অধিকার চেতনা নিজেরা যেমন অনুভব করছি, তেমনি সবাইকে বোঝাতে পারছি। কিন্তু ২০০১ সালে ধারণাটা ভাঙল, যখন প্রথম আমাদের ওপর হামলা হলো। তার আগেও একবার অবশ্য মনে হয়েছিল, সেই মোনেম খাঁর আমলে আমাকে রংপুরে বদলি করার সময়। আমি যখন ট্রেনে করে পুরো রাস্তাটা যেতাম, দেখতাম দেশটা দেশের মতোই আছে আর আমরা আমাদের মতো আছি।

প্রথম আলো: সেটা কী রকম?
সন্‌জীদা খাতুন: চারদিকে যে ধরনের আলোচনা শুনতাম, তাতে আমার তো মনে হতো মানুষ আমাদের চেনে। কিন্তু দেখলাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ আমাদের চেনে না। এই যে ঢাকায় আমরা এত কিছু করি, মনে করতাম সবাই বুঝি বেশ সংস্কৃতিমান হয়ে উঠল। বুঝেছিলাম, আমরা সবাই তা হইনি। পাকিস্তান হওয়ার পর তো আমরা ঘোরতর ধার্মিক হয়ে গেলাম। তখন টিপ পরাও অপরাধ। যাই হোক, আমরা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, সেটা তখনই উপলব্ধি করেছিলাম। তারপর স্বাধীনতার সংগ্রাম হলো, তখনো মনে হয়েছে আমরা আমাদের সংস্কৃতিটা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভুলে গেলাম, আমরা তো সবার মধ্যে যাইনি। অনেক পরে যখন আমাদের ওপর বোমা হামলাটা হয়, তখন বুঝলাম আমরা বিচ্ছিন্ন এবং দেশের ভেতরে এখন আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে। অথচ এতটুকু একটা দেশে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল যে আমরা সবাই একসঙ্গে হয়ে দেশটা গড়ব। কিন্তু সরকারিভাবেও কী যে হলো, সেটাও বুঝলাম না।

প্রথম আলো: সরকারিভাবে কী হতে পারত?
সন্‌জীদা খাতুন: বঙ্গবন্ধু কিন্তু বুঝতেন সংস্কৃতি ব্যাপারটা কী। তিনি একবার বলে পাঠিয়েছিলেন, ছায়ানটটা তোমরা আমার হাতে দাও। আমি দেখাব যে কী করে চালালে সংস্কৃতিটা ছড়ায়। এটা একটা মস্ত বড় কাজ হতে পারে। আমরা তখন ভয় পেয়েছি। সরকারের কাছে ঘেঁষতে সব সময়ই ভয় পাই। কারণ, কখন কোন সরকার আসবে, আমরা তো তা জানি না। আজ এই সরকার, তার কাছে গেলাম, পরে আরেক সরকার যদি অন্য কিছু বলে, তবে সেটা আমরা করতে পারব না। একবার যদি ঘেঁষি, আর তো সরতে পারা যাবে না। সে জন্য আমরা সব সময় সরে থেকেছি। আমরা সব সময় বলেছি, আমরা যাঁরা সংস্কৃতির সেবা করি, তাঁদের রাস্তাটা আলাদা। আমরা গঠন করে যাব। গঠন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু শহরে গঠন করে কী হবে? অন্য পক্ষ গঠন করছে গ্রামে।

প্রথম আলো: অন্য পক্ষ মানে?
সন্‌জীদা খাতুন: যারা আমাদের বিরুদ্ধবাদী। তারা তো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা, তখন যদি আমরা বেরোতে পারতাম, সহায়তা পেতাম সরকারের থেকেও, সরকারও এ ব্যাপারে খুব সচেতন হতো, যদি শেখ মুজিবের হত্যাটা না ঘটত, তাহলে হয়তো দেশটা এভাবে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত না। আমি তো ২০১৫ সালে বললাম, চলুন আমরা সবাই মিলে অস্ত্র ছাড়াই সংগ্রাম করি। সংস্কৃতি দিয়ে সংগ্রাম করি। চেষ্টাও খানিকটা হলো।

প্রথম আলো: চেষ্টাটা কী ধরনের ছিল?
সন্‌জীদা খাতুন: চেষ্টাটা হলো, ঢাকার বাইরে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। মেহেরপুরে একটা দল গেল। নালন্দা স্কুলের একটা বাচ্চাদের দল। ওরা ওখানে গিয়ে ইতিহাস কথা কও নাটকে অভিনয় করল। সেখানে তো স্বাধীনতার ইতিহাস পুরোটা এসেছে। সেটা দেখে ওখানকার মানুষ খুবই আবেগাপ্লুত হয়েছিল। শিশুদের জড়িয়ে ধরেছে। তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গেল একটা দল মানুষের গান গাই পালা নিয়ে। সেখানে পুঁথিপাঠ আছে। এই যে একটা ব্যাপার আছে, মানুষের পরিচয়টা মনুষ্যত্বে, এই কথাটা ওই পালার মধ্যে বলা হয়েছে। গ্রামের সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে, গ্রামের গান, পুঁথিপাঠ ও কোরআন শরিফের আয়াত পড়ে তার অনুবাদ আছে সেই পালায়।

প্রথম আলো: সেই চেষ্টা কি বিফল হলো?
সন্‌জীদা খাতুন: যাঁরা কাজটা করতে ঢাকার বাইরে যাবেন, আসলে তাঁদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। ছোটখাটো চাকরি করেন। আমি একবার সরকারের ওপরমহলে বলেছিলাম, কিছু টাকা পেলে আমাদের কাজটা করতে সুবিধা হবে। কিন্তু ওপর থেকে খুব একটা সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। আমরা আসলে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অর্থের সংকটটা প্রবল।

প্রথম আলো: অর্থের সংকট একটা বড় ব্যাপার বটে। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না, দায়বদ্ধতার জায়গাটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
সন্‌জীদা খাতুন: দায় বা কমিটমেন্টের অভাব ভীষণ। অনেকেই দায়বোধ করে না। আমাদের মূল্যবোধ ক্ষয়ে গেছে। যা দেখছি, তাতে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। যিনি খেতে পান না, তিনি তো বড় বড় কথা শুনতে পারেন না। তাঁদের একেবারে পেটে টান পড়ে। তাঁদের হাতে যদি কোনো টাকা দেওয়া যেত! সেই কাজটা কিন্তু করেছে অন্য পক্ষ। এই যে তাদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে ওরা, সে তো টাকা দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে টাকা আসছে, ওদের তো অসুবিধা নেই। এই টাকা দিয়ে সাধারণ মানুষের মাথা কিনে ফেলেছে। এখানে আমরা মার খেয়ে গেছি।

প্রথম আলো: তার মানে, সামনে হতাশা ছাড়া কি কিছু নেই?
সন্‌জীদা খাতুন: না, পুরোপুরি হতাশ হইনি। আমি যখন গ্রামে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম, তখন মানুষ কিন্তু খুবই আপ্লুত হয়েছিল। সবাই বলেছিল, হ্যাঁ, আমরা করতে চাই। তাহলে আমিই কি সব মানুষকে জড়ো করতে পারছি না? আমাদের একটা পাঠচক্র আছে, সেখানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখাগুলো পড়ি। আলোচনা করি। মানবতা নিয়ে পড়ি, আলোচনা করি। নানা ধরনের কবিতা পড়ি, নাটক পড়ার চেষ্টা করি। এসব কিসের জন্য করছি? যদি যেতে পারি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তবে তাদের শোনাব। পারফরম্যান্সের একটা সুবিধা আছে, এটা শুধু আনন্দ করা নয়। কিছু কিছু তো মানুষের মনে ঢোকে। সংগীত, আবৃত্তি, নাটক এমন জিনিস। কিন্তু কেন যে আমরা ঠিক জোট বাঁধতে পারছি না, এটা নিয়ে আমি মনে মনে খুবই কষ্টে আছি। কাজটা করতে পারলে শান্তি হতো। জীবনে তো কিছুই করতে পারলাম না। যতই চেষ্টা করেছি, সেগুলো তো সে রকম ফলপ্রসূ হলো না। আমরা তো বারবারই মার খেয়ে চলেছি। গ্রামে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার, সেটা তো গ্রামের মানুষকেও বুঝতে হবে। আশার জায়গা তৈরি হতে পারে, যদি জোট বাঁধতে পারি।

প্রথম আলো: এই বয়সেও আপনি পড়াশোনা করছেন। সম্প্রতি নজরুল ও জসীমউদ্দীনকে নিয়ে বড় দুটি কাজ করলেন। হঠাৎ তাঁদের কথা ভাবছেন কেন?
সন্‌জীদা খাতুন: এগুলো আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। সবাই তো বলে, আমি শুধু রবীন্দ্রসংগীত গাই আর রবীন্দ্রনাথ পড়ি। এ নিয়ে আমার একটা অভিমান আছে। আমি যখন রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ লিখছিলাম, থিসিস, তখন ভেবেছিলাম এরপর আমি নজরুলসংগীতের ভাবসম্পদ নিয়ে লিখব। কিন্তু যখন পড়াশোনা শেষে ভারত থেকে ফিরে এলাম, তখন চারপাশে সবাই আমাকে আঙুল তুলে দেখায়-‘এ তো রবীন্দ্রসংগীত’। আমি যে নজরুলকে নিয়ে ভাবতে পারি, নজরুলের গান ভালোবাসতে পারি, নজরুলের প্রতি আমার আকর্ষণ থাকতে পারে, তা বিশ্বাসই করে না। এই যে পরিস্থিতিটা, সেটা আমাকে আঘাত দিয়েছে। নজরুল নিয়ে আমি পাকিস্তান আমলেও লিখেছি। এবারে মনে হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু আমাকে সুযোগ দিয়েছে লিখবার, আমি নজরুলের গদ্য নিয়ে একটা লেখা লিখি, আমারও পড়া হলো ভালো করে, আমার বক্তব্যটাও আমি তুলে ধরতে পারলাম।

প্রথম আলো: আর জসীমউদ্দীন?
সন্‌জীদা খাতুন: জসীমউদ্দীন আমার বড্ড প্রিয় কবি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি জসীমউদ্দীন পড়াতাম। জসীমউদ্দীনের জীবনকথা নামে যে বইটা আছে, সেটা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। একটা মানুষ নিজের গড়ে ওঠার ক্রমটা এমন সুন্দর করে দেখিয়েছেন (হয়তো সব ধারাবাহিকভাবে দেখাতে পারেননি, এলোমেলো হয়েছে, তবে আমি দেখেছি, স্মৃতিকথা এলোমেলোই হয়, রবীন্দ্রনাথও পারেননি), সমস্তটার ভেতর দিয়ে যে মানুষটা উঠে আসছেন, এই মানুষটাকে তাঁর বিশেষ বিশেষ সৃষ্টির মধ্যে স্থাপন করে দেখার চেষ্টা করেছি।

প্রথম আলো: আপনার এখনকার ভাবনাগুলোর কথা জানতে চাই।
সন্‌জীদা খাতুন: মাঝে মাঝে অনেকেই বলে, আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। এইটুকুই আশার কথা। তবে সংগঠিত হতে হলে কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করা দরকার। কোনোখান থেকে টাকা পেয়ে যাব-আমি এমন আশা করি না। আমার মনে হয় নিজেদেরই টাকা দিয়ে এটা করে যেতে হবে। আমিও দেব, আমি তো মাস্টার মানুষ, গরিব মানুষ। আমার টাকা যেটুকুন আছে, তা থেকে আমিও দিলাম। নিজের জন্য একটু পুঁজি রাখতে হবে, অসুখ করলে যাতে চিকিৎসা হয়। কিন্তু এই করেই আমাদের শুরু করা দরকার।

প্রথম আলো: বয়স কি একটা ব্যাপার?
সন্‌জীদা খাতুন: সংখ্যা দিয়ে মনে হয়, এমন কিছু না। শরীর দিয়ে বুঝি একটু কাহিল হয়ে পড়ছি। আগে মনে হতো ষাট বছর, ওরে বাবা! সত্তর বছর! সাংঘাতিক! আশি বছর যখন হয়ে গেল, তখন থেকে আর এই সব নিয়ে ভাবি না। তবে বলি, নতুন প্রযুক্তির সুবিধাটা কিন্তু নিতে হবে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে হবে নিজেদের অর্জনটা। তরুণেরা এভাবেও আকৃষ্ট হবে নিজের সংস্কৃতির প্রতি।

প্রথম আলো: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সন্‌জীদা খাতুন: ধন্যবাদ।