নারীর এগিয়ে চলার সংগ্রাম

আজ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই লেখাটি শুরু করছি এই সংগঠনের জেন্ডার কোর্সের প্যানেল আলোচনায় নানা পেশার নারীর অভিজ্ঞতা দিয়ে। পোশাককর্মী ফাতেমা আক্তার বলেছেন, ‘কাজ আমাকে নতুনভাবে জীবন চিনিয়েছে। একটা সময় রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, বখাটেরা উঠিয়ে নিতে চেয়েছে। আমি প্রতিরোধ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, থেমে থাকিনি।’

সহিংসতার শিকার শিলার উক্তি, ‘আমি ছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। মুক্ত আকাশের পাখি, ডানা মেলে উড়তাম। কিন্তু হঠাৎ আমার যাত্রা থেমে গেল কিছু বখাটে ছেলের যৌন হয়রানির কারণে। কিন্তু আজকে আমি তা কাটিয়ে উঠেছি, পড়াশোনা করছি। এখন আমি ভয় করি না।’ বীথি জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। মাঠে খেলা শুরু করলে এলাকায় বলা হতো মেয়েদের খেলা একটি বেদাতি কাজ। এখন এলাকার চেয়ারম্যান তাঁকে সম্মান করেন।

বাংলাদেশের নারীর বহুমাত্রিক সংগ্রামের বড় সংগঠন মহিলা পরিষদ। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল নারী নেত্রী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এবং মালেকা বেগমকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ছিল মহিলা পরিষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। নারীর অধিকারভিত্তিক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংগঠন হিসেবে মহিলা পরিষদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ৪৮ বছরে তা একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সংগঠনের হাজার হাজার সদস্য ও কর্মীর মেধা, শ্রম ও স্বেচ্ছাসেবা। সংগঠন বিস্তৃতি লাভ করেছে ৫৮টি জেলায়, রয়েছে ২ হাজার ৩২৫টি তৃণমূল শাখা। স্বেচ্ছাসেবী সদস্যের সংখ্যা দেড় লাখ। 

বাংলাদেশে নারীদের নানা ইতিবাচক অর্জন রয়েছে। দক্ষতা ও সক্ষমতায় নারীর অভিযাত্রা নতুন নতুন দিগন্ত স্পর্শ করছে। দেশের উন্নয়নে নারী রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু এসবের বিপরীতে যে চিত্র দেখা যায়, তা খুবই উদ্বেগজনক। নারীর অধিকার রক্ষায় অনেক নীতি ও আইন প্রণীত হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌতুক নিরোধেও আইন আছে। কিন্তু এখনো ৮৭ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার, ৯২ শতাংশ নারী গণপরিবহনে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে, বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশের ওপরে। নারী একদিকে কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যানবাহনে নিগ্রহের শিকার হচ্ছে অন্যদিকে গৃহকোণও তার জন্য নিরাপদ নয়।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি ভয়াবহ অপরাধে যারা জড়িত, তাদের মাত্র ৩ শতাংশ শাস্তি পেয়েছে। ৫৫ শতাংশ অপরাধী খালাস পেয়েছে, ৪১ শতাংশ নানাভাবে অব্যাহতি পেয়েছে। এই তথ্য নারীর অগ্রগতি ও নিরাপত্তার প্রধান বাধা। আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে না, ফলে তারা আরও উৎসাহিত হচ্ছে। আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনকে নারীর সমস্যা বলে বিবেচনা করা হয় না, যা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ঘটেছে।
নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ে নারীর সম-অংশগ্রহণ। সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ ও সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।’ সম্প্রতি আরও ২৫ বছরের জন্য সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন রাখার যে সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের সভায় গৃহীত হয়েছে, তা উন্নয়ন ধারায় নারীর সম-অংশগ্রহণের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিসহ ইতিপূর্বে গৃহীত সরকারের সব নীতি, ঘোষণা ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পরিপন্থী। নারী-পুরুষের অসমতা মোচনের লক্ষ্যে সিডও সনদসহ বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় নারীর জন্য যেসব সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তা ছিল সাময়িক।
বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে সংসদে নারী আসনে সংরক্ষিত পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে নারী সংগঠনগুলোর দাবি হচ্ছে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন। সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদেরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত না হয়ে সংসদ সদস্যদের দ্বারা মনোনীত হওয়ার কারণে তাঁরা নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের কাছে দায়বদ্ধ থাকছেন। জনগণের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা থাকছে না। আগামী ২৫ বছরের জন্য মনোনয়ন পদ্ধতি বহাল রাখা নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ। এটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন দর্শনেরও পরিপন্থী।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তাকে বেগবান করতে হলে অধিকারহীনতা, সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে বাস্তব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নারী উন্নয়নের মৌলিক ক্ষেত্রের বৈপরীত্যগুলো দূর করে নারীর সাংবিধানিক ও মৌলিক নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে জেন্ডার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চার দশকের বেশি সময়জুড়ে নারীর অধিকার অর্জনের সাহসী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে বাস্তবায়িত হতে পারে ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ।

সীমা মোসলেম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক