শিক্ষার দুই মন্ত্রী চাইলেই পারেন!

এইচএসসি পরীক্ষার আগে সারা দেশে টান টান উত্তেজনা ছিল আগের মতো এবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করেছিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের ২৫ মিনিট আগে ঠিক হবে কোন সেট প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার কাজে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কেন্দ্রে স্মার্টফোন ব্যবহারের ওপরও বিধিনিষেধ ছিল। কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষার ১২টি পত্রেরই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেলে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বিরত রাখেন।

স্বস্তির কথা হলো চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষা হয়েছে। এখনো চূড়ান্ত কথা বলা না গেলেও এসএসসির সঙ্গে তুলনা করলে লক্ষণটা ভালো বলতে হবে। এতে প্রমাণিত হলো সরকারের সতর্ক তৎপরতা ও কঠোর নজরদারি ফল দিয়েছে। আশা করি বাকি পরীক্ষাগুলো প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ছাড়াই শেষ হবে।

কিন্তু অস্বস্তির দিক হলো রাজশাহী, মাদারীপুর, লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জায়গায় ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সারা দেশে ‘খ’ সেটে পরীক্ষা হলেও কালকিনির ইউএনও ‘ক’ সেট প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন সংশ্লিষ্টদের। আর লালমনিরহাটের কয়েকটি কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ২০১৬ সালের প্রশ্নপত্রে। বৃহস্পতিবার রাতে যখন রাজশাহীর প্রথম আলো অফিসে সহকর্মী আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদের সঙ্গে বসে কাজ করছিলাম, তখনই একজন টেলিফোনে বলেন, রাজশাহীর একটি কেন্দ্রে ‘ক’ সেটে বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, কেউ তাঁদের কাছে এ রকম অভিযোগ করেননি। তবে অভিযোগটি তিনি খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন।

যে পরীক্ষার সঙ্গে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জড়িত, তা নিয়ে এ রকম ছেলেখেলা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি করতে পারেন, সেটি ভাবতেও কষ্ট হয়। এদিকে ঢাকার কয়েকটি কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিরা আইন ভেঙে কালো গ্লাসধারী গাড়িতে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আনা-নেওয়ার কাজ করেছেন। অনেকের হাতে স্মার্টফোন ছিল, যদিও এসব ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এই দায়িত্বহীন কর্মকর্তাদের হাতে শিক্ষা কিংবা শিক্ষার্থী কোনোটাই নিরাপদ নয়।

আরেকটি বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এবারে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখের মতো। আর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। এসএসসি থেকে এইচএসসির ব্যবধান মাত্র দুই বছর। আজ যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা দুই বছর আগে এসএসসি পাস করে এসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে সাত লাখ শিক্ষার্থী কমা খুবই উদ্বেগের বিষয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে চলতি বছর থেকে প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) প্রশ্নপদ্ধতি বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এর আগে রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এমসিকিউ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। বাংলাদেশে এই কোনো সংসদীয় কমিটির সুপারিশ সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী গ্রহণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। যুক্তি দেওয়া হয়েছে এমসিকিউ প্রশ্নের জন্যই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ‘সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফাঁস রোধে প্রশ্নপত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হয়, যাতে পরীক্ষার আগমুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও কোনো কাজে না আসে। সে ক্ষেত্রে যোগ্যতাভিত্তিক (সৃজনশীল) প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আগামী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থেকে শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার কথা বলা হয়। তবে কেমন প্রশ্ন হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এমসিকিউর বদলে কোন ধরনের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি প্রস্তাব করবে। তার ভিত্তিতে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কমিটি প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ প্রশ্নপদ্ধতি বাদ দিয়ে বিকল্প উপায়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করে।

এ ছাড়া পরীক্ষাপদ্ধতি আরও টেকসই করতে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এসবের মধ্যে আছে ৬৪টি জেলাকে আটটি গুচ্ছে বিভক্ত করে আট সেট প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি অব্যাহত রাখা, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের আসনে বসানো, কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপযুক্ত পুলিশ প্রহরায় কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছানো নিশ্চিত করা, পরীক্ষা কেন্দ্রে কেন্দ্রসচিব ছাড়া অন্যদের মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিষিদ্ধ করা, প্রতিবছর শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে দক্ষ, মেধাবী, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য শিক্ষক, কর্মকর্তাদের তালিকা সংগ্রহ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া, বিদেশে অবস্থিত কেন্দ্রগুলোর জন্য সরবরাহ করা প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান এমসিকিউ প্রশ্ন বাদ দেওয়াকে বিপ্লবাত্মক সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন। এমসিকিউ প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরেই। তখন শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিরা এর পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। এখন বলছেন, কাজটি ঠিক হয়নি। এমসিকিউ বাদ দেওয়া জরুরি।

শিক্ষাবিদেরা কিন্তু আগেই এমসিকিউর কুফলের কথা বলে আসছিলেন। শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়, কোচিং-বাণিজ্য, নোট বই, গাইড বইয়ের পেছনেও রয়েছে এমসিকিউ প্রশ্ন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এমসিকিউ প্রশ্নের কারণে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষমুখী না হয়ে কোচিংমুখী হয়ে পড়েছে। অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েরা ক্লাসে কী শিখছে, সেদিকে নজর না দিয়ে এমসিকিউর মাধ্যমে কত বেশি নম্বর পাচ্ছে, তার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করছেন।

পদ্মা-যমুনায় অনেক পানি প্রবাহিত হওয়ার পর এখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলছেন, এমসিকিউ বা বহুনির্বাচনী বাছাই প্রশ্ন বাতিল করা একটি বিপ্লবাত্মক সিদ্ধান্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, সেই বিপ্লবী কাজটি তাঁরা আগে কেন করলেন না? প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রীর এখতিয়ার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তাঁর কথা অনুযায়ী প্রাথমিক সমাপনীতে চলতি বছর থেকে এমসিকিউ থাকবে না। কিন্তু মাধ্যমিকে যে বহুনির্বাচনী বাছাই প্রশ্ন চালু আছে তার কী হবে? প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে প্রাথমিকে এমসিকিউ বাতিল করা হলে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সেটি রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে?

প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার অভিভাবকদের সুদূরপ্রসারী বা সুচিন্তিত কোনো পরিকল্পনা নেই। যখনই সামনে কোনো সমস্যা আসে, তখন সেটি তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেন। ২০১০ সালে বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে শিক্ষানীতি চালু করা হয়েছিল শিক্ষাব্যবস্থায় ‘বিপ্লবাত্মক’ পরিবর্তনের লক্ষ্যে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কোনো পরিবর্তনই লক্ষ করিনি। ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ছিল প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে সেটি গ্রহণও করা হয়েছিল। কিন্তু এখন নানা অজুহাতে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণিতেই সীমিত রাখা হচ্ছে। মাঝখানে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার বাড়তি বোঝা চাপানো হয়েছে। এতে কোচিং-বাণিজ্য ও নোট বই বিক্রেতাদের ব্যবসা রমরমা হলেও শিক্ষার কোনো উন্নতি হয়নি।

এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ইতিবাচক বলেই মনে করি। এইচএসসি পরীক্ষাটি যদি শেষ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস ছাড়াই শেষ হয়, মানুষ আশান্বিত হবে। প্রাথমিকে এমসিকিউ বাতিল হলে শিক্ষার্থীদের ঘাড় থেকে কোচিং ও নোট বইয়ের বোঝাও লাঘব হবে। তাহলে মানুষ ভাববে, দুই মন্ত্রী চাইলেই পারেন।

সোহরাব হাসান : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com