রথীশ হত্যা ও আইন প্রয়োগ

গত ৩০ মার্চ শুক্রবার সকাল সোয়া ছয়টার দিকে রংপুরের সুপরিচিত আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক নিজের বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। অচিরেই খবর ছড়িয়ে পড়ে, তিনি নিখোঁজ হয়েছেন। বাংলাদেশে নিখোঁজ সংবাদ এখন গুরুতর দুঃসংবাদ। কেউ ‘নিখোঁজ’ হলেই জনমনে প্রশ্ন জেগে ওঠে, ‘গুম’-এর তালিকায় আরও একজন যুক্ত হলেন না তো? জনধারণায় ‘নিখোঁজ’ আর ‘গুম’ এখন প্রায় সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে।

রথীশ চন্দ্র ভৌমিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক; তিনি রংপুরের এক বিশেষ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি, রংপুর আইনজীবী সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক, রংপুর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট ও রংপুর জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে এ রকম একজন প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তির নিখোঁজ সংবাদে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। তাই দুঃসংবাদটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ, সড়ক অবরোধ, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি শুরু হয়। আদালতের আইনজীবীরা ধর্মঘট পালন করেন, তাঁকে উদ্ধারের জন্য সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়, একপর্যায়ে গণ-অনশনও শুরু হয়। দেশের মুদ্রিত, সম্প্রচার ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রথীশ চন্দ্রের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি, আলোচনা, জল্পনাকল্পনা চলে। এককথায় সারা দেশে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

সব মিলিয়ে সরকারের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে রংপুরের জেলা প্রশাসক বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন; তিনি তাঁদের এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে ঢাকা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে ফোন করেছিলেন, প্রশাসন রথীশ চন্দ্রকে খুঁজে বের করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।

জেলা প্রশাসকের এই আশ্বাস পূরণ হবে, উৎকণ্ঠিত রংপুরবাসীর এমন ভরসা ছিল না। কারণ অতীতে অনেক ঘটনায় সরকার বা প্রশাসনের, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও আশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তাই রথীশ চন্দ্রের সন্ধানের দাবিতে রংপুরবাসী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সংবাদমাধ্যমের শোরগোল আরও উচ্চকিত হয়ে উঠল। অবশেষে ৪ এপ্রিল দুপুরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক ঢাকা থেকে রংপুর গিয়ে র‍্যাব-১৩-এর কার্যালয়ে সংবাদকর্মীদের ডেকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে রংপুর শহরের একটি নির্মাণাধীন বাড়ির মাটি খুঁড়ে রথীশ চন্দ্রের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে র‍্যাব। রথীশের স্ত্রী এ হত্যার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেন এবং লাশের অবস্থান র‍্যাবকে জানান বলে র‍্যাবের মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন।

যাহোক, রথীশ চন্দ্র খুন হয়েছেন এবং তাঁর মৃতদেহ র‍্যাব উদ্ধার করেছে—এই সংবাদ দেশবাসী বেশ তাড়াতাড়িই জানতে পেরেছে। আমাদের আইনের প্রয়োগচর্চার সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিচারে এটাকে একটা অগ্রগতি হিসেবে দেখা যায়। কারণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ (জীবিত বা মৃত) জানানোর ক্ষেত্রে এ রকম সাফল্য নিকট অতীতে খুব একটা দেখাতে পারেনি। কয়েক বছর ধরে লোকজন নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাঁদের কোনো খোঁজ বের করতে পারছে না। কারও কারও নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন পর বা অনেক দিন পর নিখোঁজ হওয়ার স্থান থেকে অনেক দূরের কোনো স্থানে তাঁর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কারও কারও লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। কারও কারও সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না—বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন—এই খবরটুকুও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের জানাতে পারছে না আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। নিখোঁজ হওয়ার অনেক দিন পর নিখোঁজ ব্যক্তিটি উদ্‌ভ্রান্ত অবস্থায় ফিরে এসেছেন, কিন্তু রহস্যময়ভাবে নীরব হয়ে গেছেন—এমন ঘটনাও বেশ কয়েকটি ঘটেছে।

সুতরাং এসব বিবেচনায় রংপুরের র‍্যাব রথীশ চন্দ্রের লাশ উদ্ধার করে এক ব্যতিক্রমী কর্মসম্পাদন করেছে। অবশ্য এই ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য একটা চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হলো। অনেক মানুষের মনে এমন বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আন্তরিকভাবে চাইলে যেকোনো অপরাধের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছেন, দীর্ঘদিন ধরে যাঁদের কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না, র‍্যাব বা অন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেন তাঁদের খোঁজ জানাতে পারছে না? এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গত নভেম্বরে হিসাব দিয়েছিল, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯৫ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন। পরে বিভিন্ন সময়ে তাঁদের মধ্য থেকে ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরে এসেছেন ১৯৫ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৪৮ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। নিখোঁজ অনেক ব্যক্তির স্বজনেরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন, তাঁদের স্বজনদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন। টাকার জন্যও মানুষ গুম ও খুনের ঘটনা আছে। একটা বড় উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা।

এ বিষয়ে একটা সাধারণ মনোভঙ্গির কথা বলা দরকার। কেউ নিখোঁজ হলেই মানুষের মনে প্রথম সংশয় জাগে: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যাননি তো? সাধারণ মানুষের মনোভঙ্গি এ রকম হওয়ার কারণ, অতীতে অনেক মানুষকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে পেশাদার অপরাধীসহ অন্য সব ধরনের অপরাধীর জন্য একটা আড়াল তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ নিখোঁজ হলেই যদি র‍্যাব, পুলিশ, ডিবি পুলিশের দিকে লোকে সংশয়ের আঙুল তোলে, তাহলে পেশাদার খুনি-অপহরণকারীদের পক্ষে মানুষকে গুম করে পার পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়; এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পক্ষে জন-আস্থা ধরে রাখা অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। অপরাধের প্রতিকার করার প্রক্রিয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যথাযথ আইনানুগ পন্থা বা ‘ডিউ প্রসেস’ অনুসরণ না করলে এ রকম বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। সে জন্য প্রথমে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: কোনো অবস্থাতেই যথাযথ আইনানুগ পন্থার বাইরে যাওয়ার অনুমতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দেওয়া হবে না। কোনো সংস্থার কোনো সদস্য নিজের দায়িত্বে তেমন কিছু করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার চর্চা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। কারণ, এটা অনৈতিক, আইনের শাসনের নীতির পরিপন্থী, আইন প্রয়োগব্যবস্থার জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর এবং শেষবিচারে আত্মঘাতী। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলোর যে ক্ষতিসাধন করা হয়, অবক্ষয়ের নিয়মে সেই ক্ষতি ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে সদস্য দেখছেন, তাঁকে সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থে অনৈতিক ও অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই সদস্য নিজের স্বার্থে গুরুতর অপরাধ সংঘটনে দ্বিধান্বিত না-ও হতে পারেন।

তৃতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে, জনমনে তাদের সম্পর্কে আস্থা বাড়ানোর চেষ্টা করা একান্ত প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যে কিছু ঘাটতি রয়েছে, এবং এখনই আস্থা উদ্ধারের জন্য সচেষ্ট না হলে সেই ঘাটতি যে আরও বাড়তেই থাকবে, এই সত্যটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন আগে।

মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক