বাংলাদেশ কি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যাবে?

এক বছরের মধ্যে ভারত সরকার একাধিক বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করেছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তিন ধরনের পাটপণ্যের ওপর এই শুল্কারোপ করা হয়। আর জুন মাসে এই শুল্কারোপ করা হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের ওপর। এ ছাড়া গত মার্চ মাসেই বাংলাদেশে তৈরি মাছ ধরার জালের (ফিশিং নেট) একই ধরনের শুল্কারোপের সুপারিশ করেছে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত ডিরেক্টরেট জেনারেল অব অ্যান্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড এলাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি)। এগুলোর মধ্যে তিন ধরনের পাটপণ্যের (পাটের সুতা, পাটের বস্তা ও চট) ওপর আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কই বেশি উদ্বেগের কারণ হয়েছে। কেননা, পাটপণ্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। এর বড় অংশই যায় ভারতের বাজারে।

ভারতীয় পাটপণ্য প্রস্তুতকারকেরা অভিযোগ তুলেছিলেন যে বাংলাদেশি পাটপণ্য রপ্তানিকারকেরা ভারতে এসব পণ্য ডাম্প করছেন। অর্থাৎ, উৎপাদনমূল্য বা স্থানীয় বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করছেন। এটা করা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া ভর্তুকির সুবিধা ব্যবহার করে। এতে ভারতীয় পাটপণ্য অসম প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে। তাদের এই অভিযোগ আমলে নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান চালায় এবং দুটি বাদে সব পাটকলের প্রস্তুতকৃত এসব পণ্যের ওপর প্রতি টনে সর্বনিম্ন ১৯ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৩৫২ ডলার হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করে। এর ফলে এত দিন দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় বাংলাদেশি পাটপণ্য ভারতে যে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পেয়ে আসছিল, তা থেকে বঞ্চিত হলো। উচ্চ শুল্কের কারণে ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি কমে গেল।

২০১৫ সালের অক্টোবরে যখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ডাম্পিংয়ের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে, তখন থেকেই বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানিকারকেরা বিচলিত হয়ে পড়েন। তদন্তের অংশ হিসেবে ভারত থেকে বিভিন্ন তথ্য চেয়ে যে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়, তা বেশির ভাগ উত্পাদক ও রপ্তানিকারকের কাছে পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। ফলে বেশির ভাগই কোনো জবাব দেননি বা দিলেও ঠিকমতো দিতে পারেননি। তাই তাঁরা প্রথমে তদন্তে অসহযোগিতার কাতারভুক্ত হয়ে যান। তারপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ২৬টি পাটকলের প্রদত্ত উত্তর নমুনা হিসেবে নেয়। সেগুলোর মধ্যে ১২টি পাটকল প্রত্যক্ষ পরিদর্শনের জন্য বেছে নেয়। ২০১৬ সালের আগস্টে তারা সেগুলো পরিদর্শন করে। এ ছাড়া ভারতীয় উত্পাদকদের কাছ থেকেও বাংলাদেশি পাটপণ্যের কারণে তাদের কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়। ভারতীয় আমদানিকারকদের কাছ থেকেও মতামত নেওয়া হয়। বাংলাদেশি রপ্তানিকারক বা তাদের প্রতিনিধিদের মৌখিক ভাষ্য গ্রহণের জন্য দিল্লিতে ডাকা হয়। এরপর যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলে, বাংলাদেশি পাটপণ্য ভারতে কম দরে রপ্তানি বা ডাম্প করায় ভারতের স্থানীয় পাটশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাই এই অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ যৌক্তিক। শুধু বাংলাদেশি পাটপণ্য নয়, নেপালি পাটপণ্যের ওপরও ভারত এই শুল্ক আরোপ করেছে।

বিপরীত দিকে, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা বলেন, গুণমান ও দরের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ভারত এখন এ ধরনের মুক্ত বাণিজ্যবিরোধী বা বাণিজ্য সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। তাঁরা এই শুল্ক অপসারণে সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেনদরবার করে আসছেন অনেক দিন ধরে। সরকার ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার কথা বলেছে। গত ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ বিষয়টি উত্থাপন করেছে, কিন্তু ভারতীয় পক্ষের কোনো সাড়া মেলেনি। আসলে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের কোনো সমাধান সম্ভব নয়। ভারত যেহেতু এটা আরোপ করে ফেলেছে, সেহেতু পাঁচ বছর পর্যন্ত এটা বহাল থাকবে।

এ অবস্থায় একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে প্রকাশ, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিরোধ নিষ্পত্তি দলের (ডিসপিউট সেটেলমেন্ট বডি বা ডিএসবি) শরণাপন্ন হতে পারে। পাট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। একাধিক বড় রপ্তানিকারকও ভারতীয় অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক মোকাবিলায় এখন ডব্লিউটিওর দ্বারস্থ হওয়ার পক্ষে। কিন্তু ডব্লিউটিওতে এ বিষয়টি নিয়ে যাওয়া অনেক বড় সিদ্ধান্ত, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষ লোকবল ও আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি এটাও যাচাই করে দেখতে হবে যে ভারতীয় পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পর্যাপ্ত উপকরণ বাংলাদেশের আছে কি না। এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আইনি লড়াই,  সে জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবী পেতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবশ্য জেনেভাভিত্তিক ‘অ্যাডভাইজরি সেন্টার অন ডব্লিউটিও ল’ থেকে খুব কম খরচে আইনি পরামর্শ বা আইনজীবী সহায়তা পাবে।

এটা ঠিক যে এক যুগ আগে বাংলাদেশ সীমিত সামর্থ্য দিয়েই রহিমআফরোজের লিড অ্যাসিড ব্যাটারির ওপর ভারতীয় অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক মোকাবিলায় ডব্লিউটিওর দ্বারস্থ হয়েছিল এবং তাতে সাফল্য পেয়েছিল। একেবারে প্রথম ধাপে প্রথম দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরপরই ভারত সরকার অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। বিশেষত অন্য দেশের পণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ এবং ভারতীয় পণ্যে আরোপিত এই শুল্ক মোকাবিলা—এ দুই কাজে ভারতের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনেক বেড়েছে। সুতরাং, ভারতীয় পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে যথেষ্ট কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ট্যারিফ কমিশন অ্যান্টি-ডাম্পিং বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ট্যারিফ কমিশনের একার পক্ষে তেমন কিছু করার সুযোগ নেই। এ কাজে বাংলাদেশি পাটপণ্য উত্পাদক ও রপ্তানিকারকদের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। সমস্যা হলো, তাঁদের অনেকে এত সীমিত পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেন যে তাঁদের কাছে এই অ্যান্টি-ডাম্পিং চ্যালেঞ্জ করা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশির মতো মনে হতে পারে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে বিকল্প বাজারে তাঁদের পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কাজেই তাঁদের সাড়া কতটা  মিলবে, তা দেখার বিষয়। তবে একাধিক বড় রপ্তানিকারক এই কাজে সহযোগিতা প্রদানের কথা জানিয়েছেন।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিভিন্ন মাত্রা বিবেচনায় নিলে এখানে সরকারের জন্য কিছুটা স্পর্শকাতরতা থাকতে পারে। যদিও বাণিজ্যবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ডব্লিউটিওর দ্বারস্থ হওয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের অবকাশ নেই। বাংলাদেশ কতটা তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে ভারতীয় পদক্ষেপকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, সেটাই মুখ্য বিষয়। বিষয়টি আইনি লড়াই। এ জন্য নিজেদের সর্বাত্মক প্রস্তুতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা না করে শুধু ডব্লিউটিওতে যাওয়ার কথা বলা হবে অর্থহীন।

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক