যেভাবে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়

‘আমাদের গণতন্ত্রের কি মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে?’ এ প্রশ্নটি দিয়ে স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলাট তাঁদের নতুন বই যেভাবে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় শুরু করেছেন। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই নামজাদা অধ্যাপক। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তাঁরা বলেছেন, আমেরিকাকে নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। একসময় এই দেশকে বলা হতো ‘গণতন্ত্রের ল্যাবরেটরি’, এখন সেই দেশ ‘কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার ল্যাবরেটরি’তে পরিণত হতে চলেছে।

তাঁরা লিখেছেন: ‘আমেরিকার রাজনীতিকেরা এখন তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শত্রু বলে বিবেচনা করেন। তাঁরা তথ্যব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এমনকি নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যানের হুমকি দিচ্ছেন। যাঁরা ক্ষমতায় বসেন, তাঁদের অব্যাহত চেষ্টা নির্বাচনী আইন ও নির্বাচনী আইন নিজেদের সুবিধামতো বদলে নিতে। যাতে পরাস্ত না হন তা নিশ্চিত করতে তাঁরা মানুষের ভোটাধিকার পর্যন্ত খর্ব করতে প্রস্তুত।’

লেখক দুজন আজকের আমেরিকার কথাই বলছেন; কিন্তু এ কথা তো অনায়াসে আমাদের মতো অনেক দেশের বেলাতেও প্রযোজ্য। আমাদের রাজনীতিকেরা একে অপরের বিরুদ্ধে কোন ভাষায় কথা বলেন, তা কি আমরা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করছি না? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কি আমাদের দেশে হুমকির সম্মুখীন নয়? বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, নৈতিক অনুশাসন-এসবই কি আমাদের চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে না?

আমরা ধরে নিই গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। যেমন পাকিস্তানে হয়েছে, আমাদের দেশে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের হাতে ঘটেছে। অথবা চিলির পিনোশের হাতে ঘটেছে। এই সব দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে হটিয়ে সামরিক অফিসাররা নিজেদের বন্দুক ও ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন, তারপর সব ভিন্নমতকে দুমড়েমুচড়ে ক্ষমতার সিংহাসন দখল করে বসেন। লেভিটস্কি ও জিবলাট বলছেন, আজকে গণতন্ত্রের মৃত্যুর জন্য রাস্তায় ট্যাংক নামার প্রয়োজন নেই। ‘জেনারেলদের হাতে নয়, নির্বাচিত জননেতাদের হাতেও গণতন্ত্রের মৃত্যু হতে পারে। কোনো প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যে প্রক্রিয়ায় নিজেরা ক্ষমতায় এসেছেন, সে প্রক্রিয়া খর্ব করে তাঁরাই গণতন্ত্রের মৃত্যু ডেকে আনতে পারেন। এই মৃত্যু হয় ধীরপায়ে, কীভাবে সে মৃত্যু হয়, অনেক সময় আমরা টেরও পাই না।’

লেভিটস্কি ও জিবলাট ভেনেজুয়েলার উদাহরণ দিয়েছেন, কীভাবে প্রথমে হুগো চাভেজ ও পরে তাঁর উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরোর হাতে সে দেশে প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নীতি-ব্যবস্থাকে খুব ধীরে ধীরে হত্যা করা হয়। তাঁরা দুজনই নির্বাচিত সরকারপ্রধান, রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয়। অথচ তাঁরাই একে একে সব অর্থপূর্ণ বিরোধী রাজনীতিকদের নিশ্চিহ্ন করলেন, সংবাদপত্রের হাতে হাতকড়া বেঁধে দিলেন, বিচারব্যবস্থাকে পদানত করলেন, নাগরিক অধিকার সংস্থাগুলোকে বুড়ো আঙুলের থাবার নিচে নিয়ে এলেন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সব পদক্ষেপ নেওয়া হয় ‘আইনসিদ্ধ’ পথে। এই সব দেশে বাহ্যিক গণতন্ত্রের সব কাজকর্মই ঠিকমতো চলতে থাকে। যেমন সংবাদপত্র যথাসময়ে প্রকাশিত হয়, টক শোতে উত্তপ্ত বাদানুবাদও চলে, কেউ কেউ সরকারের সমালোচনা করেও বেশ পার পেয়ে যান। অথচ তাঁদের দেশ যে এক কঠিন অসুখে পড়েছে, দেশের মানুষ সে কথা বুঝতেই পারে না। লেখক দুজন ভেনেজুয়েলার উদাহরণে জানিয়েছেন, ২০১১ সালে এক জনমত জরিপে ৫১ শতাংশ মানুষ নিজেদের দেশের গণতন্ত্রকে ১০ পয়েন্টের মধ্যে ৮ দিয়েছিল।

স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিকেরা যখন ক্ষমতার চাবির গোছা দখল করেন, তার এক অবশ্যম্ভাবী ফল দাঁড়ায় এই যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেপরোয়া লুণ্ঠন। প্রতিবাদ করার কেউ নেই, অতএব লুটপাট ঠেকানোরও কেউ নেই। উদাহরণ হিসেবে সেই ভেনেজুয়েলার কথা ভাবুন। লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে তেলসমৃদ্ধ এ দেশটির অর্ধেক মানুষ এখন নিজেদের আয়ে ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকার, সরকারি ত্রাণ ছাড়া বেঁচে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব।

‘খোলামেলা একনায়কতন্ত্র এখন পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। সামরিক অভ্যুত্থান এখন আর হয় না। অধিকাংশ দেশ যথাসময়ে নির্বাচন করে। তারপরও গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে (অর্থাৎ নব্বইয়ের দশক থেকে) যেসব দেশে জেনারেলদের বদলে রাজনীতিকদের হাতে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জর্জিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক ও ইউক্রেন।’

আমেরিকায় গণতন্ত্রের এখনো মৃত্যু হয়নি, কিন্তু সে পথে পদযাত্রা শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার কিছু কিছু লক্ষণ হয়তো আগেই ধরা পড়েছিল। যেমন আদর্শগত বিভক্তি ও যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা। আমেরিকার কিছু কিছু গণতান্ত্রিক ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’ সেই প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করেছে। কিন্তু সবকিছু উল্টে গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। তাঁকে জিততে রাশিয়া হয়তো সাহায্য করেছে, কিন্তু যাঁদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই আমেরিকান। নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রধান শক্তি ছিল ‘ডেমাগগি’। লোকটি শুধু অযোগ্য নন, তিনি অত্যন্ত বিপজ্জনক, দেশের একাংশ মানুষের বিরুদ্ধে নির্লজ্জের মতো মিথ্যাচার তাঁর অস্ত্র। ‘ভীতি’ ছিল তাঁর কাছে একটি রাজনৈতিক কৌশল। এর বিপদ কী তা জানার পরেও রিপাবলিকান পার্টি তাঁকে সমর্থন দিয়ে গেছে। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একের পর গণতন্ত্রের সব রীতিনীতি ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছেন। অথচ অধিকাংশ রিপাবলিকান তা ঠেকানোর বদলে হয় মুখ বুজে থেকেছেন অথবা ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন, ট্রাম্পের হাত ধরে রিপাবলিকান অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন কর হ্রাস, জনকল্যাণব্যবস্থার ভাঙন অথবা পরিবেশ সংরক্ষণে সব বাধানিষেধ উপড়ে ফেলা। ফলে নাকে রুমাল বেঁধে হলেও তাঁরা ট্রাম্পের মাথায় ছাতা ধরে রেখেছেন। এরই নাম ‘শয়তানের সঙ্গে এই চুক্তি’!

লেভিটস্কি ও জিবলাট স্মরণ করেছেন, ঠিক এই ‘ডেভিলস বারগেইন’-এর হাত ধরেই জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসোলিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। পেশাদারি ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক, যাঁদের দায়িত্ব ছিল এমন একজন ভীতিকর বহিরাগতের উত্থান ঠেকানো, তাঁরা সেই দায়িত্ব পালনের বদলে আশু ফায়দার কথা ভেবে সেই ‘শয়তানের’ সঙ্গেই জোট বেঁধেছেন। সময় এলে এই বহিরাগত শয়তানের পাখা কেটে দেবেন বলে যে ভাবনা তাঁদের মাথায় ছিল, তা সত্যি প্রমাণিত হয়নি। উল্টো তাঁরাই সেই ‘ডেমাগগের’ উপাঙ্গে পরিণত হয়েছেন।

আমেরিকার ট্রাম্প, তুরস্কের এরদোয়ান, মিসরের সিসি অথবা হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান সেই সব ডেমাগগের কয়েকজন। এঁদের উত্থান ঠেকাবেন কীভাবে? এই উত্তর খুঁজতে এই মার্কিন অধ্যাপক সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছেন জার্মান-স্প্যানিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হুয়ান লিঞ্জের দিকে। তিনি ১৯৭৮ সালে তাঁর দ্য ব্রেকডাউন অব ডেমোক্রেটিক রেজিমস গ্রন্থে প্রথম স্বৈরাচারের উত্থান ঠেকাতে একটি ‘চেক লিস্ট’ তৈরি করেছিলেন। সেই তালিকা কিছুটা সংশোধন করে লেভিটস্কি ও জিবলাট একটি সহজ ফর্মুলা প্রস্তাব করেছেন। যদি কোনো রাজনীতিকের ব্যবহারে নিচের চারটি বৈশিষ্ট্যের একটি ধরা পড়ে, তাঁর ব্যাপারে অবিলম্বে সচেতন হতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-কথায় বা কাজে গণতান্ত্রিক নীতি প্রত্যাখ্যান, প্রতিপক্ষ রাজনীতিকের বৈধতা অস্বীকার, সহিংসতার প্রশ্রয় ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ সব নাগরিক অধিকারের ওপর আক্রমণ।

যেহেতু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই ট্রাম্প অথবা ফিলিপাইনের দুতার্তের মতো একজন স্বেচ্ছাচারী নেতার আবির্ভাব ঘটে, ফলে তাঁর উত্থান ঠেকানোর প্রধান দায়িত্বও রাজনীতিকদের। তাঁদের হতে হবে ‘গেটকিপার’ বা দ্বাররক্ষক। একজন হিটলার বা মুসোলিনি হয়তো উঠে আসত পারতেন না যদি মূলধারার রাজনীতিকেরা তাঁদের পাশে ছাতা মেলে না ধরতেন, অথবা তাঁদের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত না গড়তেন। বস্তুত স্বীকৃত রাজনীতিকদের সমর্থন অথবা যোগসাজশের ফলেই একজন অরবান অথবা একজন ট্রাম্প রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে যান।

বাংলাদেশের কথা ভেবে গণতন্ত্রের মৃত্যু কীভাবে হয় গ্রন্থটি লেখা হয়নি, কিন্তু অসুখের যে লক্ষণ এই দুই অধ্যাপক চিহ্নিত করেছেন, আজকের বাংলাদেশে যে তার অনেকগুলোই বর্তমান, তা অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের কী অসুখ, কী তার লক্ষণ, সে কথা আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে! গণতন্ত্রের মৃত্যু কীভাবে ঠেকাব, তার কিছু ডাক্তারি পরামর্শ তাঁরা দিয়েছেন। সেসব পরামর্শ আমরা গ্রহণ করব কি করব না, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে, অন্য কেউ এসে তা আমাদের জন্য নেবে না।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি