রহস্যপুরুষ থান শয়ে

থান শয়ে
থান শয়ে

গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বয়স ৮৫ বছর পূর্ণ হলো। আর মার্চে তাঁর অবসরজীবনের বয়স হলো সাত বছর। লোকসমাজেও তাঁকে কমই দেখা যায়। কিন্তু ২ লাখ ৬১ হাজার বর্গমাইলের মিয়ানমারজুড়ে তাঁর ছায়া সক্রিয়। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত তাঁর অনুমোদন থাকা-না থাকা নিয়ে কানাঘুষা চলে রাজধানী নেপিডোতে। তিনি জেনারেল থান শয়ে।

আমেরিকার জেনারেল ডগলাস আর্থার একদা বলেছিলেন, ‘সৈনিকেরা মরে না, তারা ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারায় মাত্র।’ মিয়ানমারের থান শয়ের ক্ষেত্রে এসে উল্টোটাই সত্য হতে দেখা যাচ্ছে। বুড়ো জেনারেলের স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিভিন্ন সময় নেতিবাচক গুজব ছড়ালেও কেউই এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত নন, দেশটির নীতিনির্ধারণী পরিমণ্ডলে তিনি প্রভাব হারিয়েছেন।

জীবনের শুরুতে পুরোনো রাজধানী মান্দালের মেইথিলায় পোস্ট অফিসে ক্লার্ক ছিলেন থান শয়ে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। হয়তো এটা কাকতালীয় যে থান শয়ের মতোই মিয়ানমারের অপর আলোচিত সামরিক শাসক নে উইনেরও কর্মজীবন শুরু পোস্ট অফিস দিয়ে। তবে নে উইনের চেয়ে থান শয়ের সামরিক জীবন ছিল অপেক্ষাকৃত বাধাবিঘ্নহীন।

২০০৯ সালে প্যারেড ম্যাগাজিন বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ স্বৈরশাসকদের যে তালিকা করে, তাতে থান শয়ের অবস্থান ছিল চতুর্থ। জিম্বাবুয়ের মুগাবে, সুদানের ওমর আল বশির এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং ইলের পরই অবস্থান ছিল মিয়ানমারের এই জেনারেলের। আলোচ্য চার ‘স্বৈরশাসক’-এর মধ্যে ওমর আল বশির ছাড়া তিনজনই রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং বশিরের বিরুদ্ধেও হেগ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গণহত্যার অভিযোগে সমন জারি করে রেখেছেন। কেবল থান শয়েকে তাঁর শাসনামলের জন্য কোথাও জবাবদিহি করতে হয়নি এবং পশ্চিমারাও তেমনটি চায়নি। কারণ, ক্ষমতার শেষ দিকে তিনি মিয়ানমারের জন্য ‘বাজার’-এর দরজা খুলে দিয়েছিলেন।

উর্দি পরেই দেশ শাসনে তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৯৮৮ সালে প্রথমে জেনারেল শ মংয়ের ক্যাবিনেটে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে এবং শ মংয়ের পরে ১৯৯২ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে সরাসরি সর্বময় ক্ষমতা হাতে নিয়ে। অন্তত ১৯ বছর নির্দয়ভাবে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা দলিত করেই দেশটি শাসন করেছেন তিনি। আর এখনো পর্দার আড়াল থেকে পরিস্থিতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন। যদিও বিশ্ব আপাতদৃষ্টিতে দেখছে দেশটির দুই ব্যক্তি অং সান সু চি ও সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইকে।

অবসরের পর সচরাচর যে দু-একটি উপলক্ষে থান শয়েকে লোকসমাজে দেখা যেত, তার একটি দেশটির ‘আর্মড ফোর্সেস ডে’। এই দিন সাবেক জেনারেলরা রাজধানীতে একত্র হন। এ বছরের ২৭ মার্চ তেমন কোনো দৃশ্যও মিডিয়ার সূত্রে মিয়ানমারবাসী দেখেনি। তবে গত বছরের মার্চে এ ধরনের একটি ছবি মিয়ানমারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এত বেশি ভাইরাল হয়েছে যে সেটা দেশটির মনোজগতে থান শয়ের প্রবল উপস্থিতি জানিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল।

তবে কেবল মিয়ানমারবাসীই নয়, দক্ষ বিদেশি কূটনীতিকেরা দেশটির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি আঁচ করতে এখনো থান শয়ের মনোভাব বুঝতে মরিয়া থাকেন। এ ক্ষেত্রে সচরাচর চীনারাই এগিয়ে থাকে। চীনের সিনিয়র নেতারা যখন মিয়ানমারে আসেন, তখন অং সান সু চি, জেনারেল মিন অং লাইয়ের পাশাপাশি থান শয়ের সঙ্গেও দেখা করে যান, তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার অছিলায়। এ ধরনের সাক্ষাতের ছবি চীনের রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়-মিয়ানমারে তাদের প্রভাবের গভীরতা বোঝাতে।

নিজের সম্পর্কে যেকোনো তথ্য প্রকাশে থান শয়ের বরাবরই আপত্তি। এমনকি তাঁর জীবনী (থান শয়ে: আনমাস্কিং বার্মা’স টাইরেন্ট)-লেখক বেনেডিক্ট রজার্সও থান শয়ের প্রকৃত জন্মতারিখ খুঁজে বের করতে পারেননি। ফলে থান শয়ের বয়স-সম্পর্কিত সব তথ্য অনুমানের ওপর নির্ভর করেই প্রচারিত।

সামরিক শাসক হিসেবে দুই দশকের জীবনে বরাবরই থান শয়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণের বিরোধী ছিলেন। জেনারেল নে উইন (১৯৬২-১৯৮৮) এবং শ মং (১৯৮৮-১৯৯২) যখন নির্মমভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো দমন করেছেন, তখন শক্তভাবেই তাঁদের পাশে ছিলেন থান শয়ে। বলা বাহুল্য, মিয়ানমারে এখন আপাতদৃষ্টিতে বেসামরিক শাসন কায়েম হলেও অং সান সু চিকে পর্দার আড়ালে লড়ে যেতে হচ্ছে থান শয়ের সঙ্গেই। ২০১৫ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পরও এনএলডির নেত্রীকে সরকার গঠনের আগে থান শয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা করে আসতে হয়েছিল এবং সেই সাক্ষাতের পর এককালের প্রতিপক্ষ জেনারেল যখন সু চিকে ‘ভবিষ্যৎ নেত্রী’ হিসেবে সম্বোধন করেন, তখনই কেবল ভোটারদের মনে এই মর্মে স্বস্তি এসেছিল, তাঁদের পছন্দ ছিনতাই হবে না এবার।

এটা প্রশ্নাতীত, থান শয়ের রহস্যঘেরা বর্তমান উপস্থিতির একমাত্র উৎস সশস্ত্র বাহিনীতে তাঁর প্রভাব। বর্তমান ‘সিনিয়র জেনারেল’ মিন অং লাইকে ২০১১ সালে কয়েক ডজন অফিসারকে ডিঙিয়ে ওই পদে বসিয়ে এসেছিলেন থান শয়ে। সে সময় বাহিনীর অনেক সিনিয়র অফিসারের চেয়ে মিন অং লাই ছিলেন অন্তত ১২-১৫ বছরের জুনিয়র। খোদ থান শয়ের সঙ্গে মিন অং লাইয়ের চাকরি-বয়সের ব্যবধান ২১ বছর। পেশাগত জীবনে মোটাদাগে স্নেহ প্রদর্শনের ঘটনা ছিল এটা। সেই স্নেহের ‘বোঝাপড়া’ থেকে মিন অং লাই এখনো সরে আসেননি।

থান শয়ের আমলেই মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা পর্যায়ে মূল নৃগোষ্ঠী বামার ব্যতীত অন্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রবেশ বন্ধ করা হয়। এর মাধ্যমে বামারদের সামনে দেশটিতে প্রভাবের পরিসর চূড়ান্ত অবাধ হয়। আর বামা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা জানেন, দেশটিতে উচ্চপদস্থ
সামরিক কর্মকর্তা মানেই একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং এরূপ পরিবারগুলোর ধন-সম্পদের বিষয়ে বিশ্বের অন্য দেশে বসে অনুমান করাও অনেক সময় বোকামিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ২০০৯ সালে থান শয়ে তাঁর নাতি নে শয়ে থ অংয়ের মাধ্যমে ব্রিটেনের ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
কেনার উদ্যোগ নিলে দেশটির পুরোনো ঔপনিবেশিক শাসক দেশ ব্রিটেনের অনেক সাংবাদিক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ বৃদ্ধ শয়ের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর কৃতজ্ঞতার আরেক
কারণ। বস্তুত, নে উইন-শ মং-থান শয়ে-মিন অং লাইয়ের প্রায় ৬০ বছর দীর্ঘ সামরিক এবং লুণ্ঠনপরম্পরা মিয়ানমারকে আজও ছদ্ম সামরিক সংস্কৃতিতেই আটকে রেখেছে। সু চি সেই লৌহকঠিনপরম্পরা ভাঙতে পারবেন-এমনটি এখন আর কেউ মনে করে না মিয়ানমারে। যেমনটি তিনি পারেননি আরাকানে টাটমা-ড’র অভিযান থামাতে। সু চি কার্যত মিয়ানমার সমরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিরোধী অবস্থানও ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন, বিশেষত যখন নিজেই তিনি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী আমার খুব পছন্দের; এটাকে আমি আমার পিতার গড়া বাহিনীই মনে করি।’

ঐতিহাসিকভাবে সু চির এই বক্তব্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ। জেনারেল অং সানের নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে থাইল্যান্ডে যে সেনাবাহিনীর যাত্রা (বর্মা ইনডিপেনডেন্স আর্মি), সেটা ছিল স্বাধীনতা, মুক্তি এবং বহুত্ববাদের অঙ্গীকারে ধন্য এবং রাজনীতি ছিল তার নিয়ন্ত্রকের আসনে। আর ১৯৬২ সালে নে উইনের হাত ধরে আজকের বার্মা বাহিনীর পুনর্জন্ম রাজনীতিবিদদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা থেকে, তখনকার ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর মডেলে। আর এ মুহূর্তে জেনারেল থান শয়ে হলেন একসময়ের সেই বার্মা বা বর্তমান মিয়ানমারের সামরিক উত্তরাধিকারের সবচেয়ে জীবন্ত কায়া, যার দীর্ঘ ছায়া পড়েছে নাফ নদীর এপারেও।

আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক