আর কত মৃত্যু হলে আমরা সতর্ক হব?

গত ২৪ মার্চ ২০১৮ তারিখ মধ্যরাতে ময়মনসিংহের ভালুকার মাস্টারবাড়ি এলাকার এক নবনির্মিত বহুতল ভবনের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। একজন অকুস্থলে নিহত, বাকি চারজনের মৃত্যু হলো হাসপাতালে। হতভাগ্যরা সবাই খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁরা ভালুকায় স্কয়ারের একটি কারখানায় ইন্টার্নি করতে এসেছিলেন।

বিস্ফোরণস্থলে গিয়ে দেখা গেল, ছয়তলা ভবনের প্রতিটি কক্ষের জানালার কাচ চুরমার। বিস্ফোরণ যেখানে হয়েছে, সেই ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমের একাধিক দেয়াল ভেঙে পড়েছে। বিস্ফোরণকবলিত ফ্ল্যাট এবং করিডরের দুই পাশের সব ফ্ল্যাটের লোহার দরজা ৯০ ডিগ্রি বেঁকে গিয়ে ছিটকে পড়েছে দূরে। জানালার একাধিক ফ্রেম উড়ে গিয়ে পড়েছে দূরের বাড়ির চালায়। টানা বারান্দার ইটের রেলিং ভেঙে পড়েছে পাশের বস্তির টিনের চালায়। ভাগ্য ভালো যে বস্তিতে তখন কোনো লোক ছিল না। ফ্ল্যাটের মেঝেতে এখানে-ওখানে পড়ে আছে হবু ইঞ্জিনিয়ারদের পীঠব্যাগ, কম্পিউটারের তার, বিভিন্ন বই, ধুতি, ফ্যাশনেবল টি-শার্ট, (মা বা বোনের হাতে) রঙিন সুতার কাজ করা কাপড়ের হাতপাখা। বিস্ফোরণে বেঁকে যাওয়া বাটির বুকে আটকে থাকা কুচানো আদার টুকরা দেখে বোঝা যায়, মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে হতভাগ্যরা রান্নার জোগাড় করছিল।

ধ্বংসের প্রকৃতি দেখে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে প্রাকৃতিক গ্যাসই এই বিস্ফোরণের কারণ। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম মনে করেন, কোনো বদ্ধ স্থানে ৩ থেকে ১০ শতাংশের মতো প্রাকৃতিক গ্যাস আর বাকি ৯৭ থেকে ৯০ শতাংশ বাতাসের একটি মিশ্রণ যদি কোনোমতে তৈরি হয়, তবে সেই মিশ্রণটি বিস্ফোরণোন্মুখ হবে। যদি দুর্ভাগ্যবশত সামান্য একটি স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয় সেই স্থানে, তবে মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটবে। সম্ভবত এ ঘটনাই ঘটেছে ভালুকার নবনির্মিত ভবনটিতে। মশার উপদ্রব ঠেকাতে ছাত্ররা হয়তো জানালা বন্ধ করে রেখেছিল। ভবনে গ্যাস-সংযোগের অনুমতি ছিল না, অথচ গ্যাসলাইন ছিল। সুতরাং গ্যাসের সংযোগটি ছিল বেআইনি এবং নিঃসন্দেহে পেশাদার কোনো গ্যাসকর্মী সংযোগটি দেননি। বেআইনি গ্যাসের লাইনে কিংবা সিলিন্ডারের গ্যাস নির্গমনপথে ত্রুটি থাকলে গ্যাস লিক হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশতে থাকে। দুর্ঘটনাস্থলে একটি সিলিন্ডার অবশ্য ছিল, কিন্তু সামসুল আলম পরীক্ষা করে দেখেছেন, সিলিন্ডারটি খালি ছিল না। সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হয়ে যদি দুর্ঘটনা হতো, তবে সিলিন্ডারটি গ্যাসভর্তি থাকার কথা নয়।

গৃহকর্মে ব্যবহৃত গ্যাস দুই রকম: প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপিজি। প্রথমটি আমাদের ‘মাথার ওপরে ওড়ে, দ্বিতীয়টি আমাদের পায়ে-পায়ে ঘোরে’। যদি সিলিন্ডার গ্যাস অর্থাৎ এলপিজি ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে, তবে সামসুল আলম মনে করেন, রান্নাঘরের দেয়ালে পায়ের সম-উচ্চতায় এবং যদি প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়, তবে মাথার সম-উচ্চতায় একটা নির্গমনপথ থাকা উচিত। গ্যাস থেকে আর কী কী বিপদ হতে পারে? জিজ্ঞেস করেছিলাম সামসুল আলমকে। কোনো সিএনজি স্টেশনে গাড়িতে যখন গ্যাস নিচ্ছেন, তখন নিরাপত্তার স্বার্থে গাড়ি থেকে নেমে দূরে সরে দাঁড়ান। প্রতিটি সিলিন্ডারের একটা সর্বোচ্চ বয়স থাকে। পুরোনো কোনো সিলিন্ডার ব্যবহার না করাই নিরাপদ। গ্যাস ধারণের ক্ষমতা আছে কি নেই, তা জানার জন্য সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা করানো দরকার। আগে অপরীক্ষিত সিলিন্ডার টেম্পো বা হিউম্যান হলার ধরনের গাড়িতে ব্যবহৃত হতো এবং দুর্ঘটনাও ঘটত দেদার। ইদানীং মালিকেরা সতর্ক হওয়ায় এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে।

যাঁরা বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করেন, তাঁরা পুরোনো সিলিন্ডার কেটে ঝালাই করে জোড়া দিয়ে একধরনের গ্যাস উৎপাদনযন্ত্র বানান। এই সিলিন্ডারে কস্টিক সোডা আর অ্যালুমিনিয়াম কুচি ঢুকিয়ে দিলে উভয় উপাদানের বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হয়। দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি একটি রেগুলেটর দিয়ে এই ‘গলাকাটা’ সিলিন্ডারের গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু বেলুন যদি বেশি বিক্রি না হয়, তবে গ্যাসের চাপ বাড়তে থাকে এবং একসময় সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে প্রতিবছর বেশ কয়েকজন বেলুনবিক্রেতা ও ক্রেতা অপঘাতে মারা যান।

দুর্ঘটনার জন্য আমাদের আধুনিক ভবনগুলোর কক্ষ ব্যবস্থাপনাও অনেকটাই দায়ী। আগেকার দিনে শোয়ার ঘর, বসার ঘর কিংবা রান্নাঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘরে ভেন্টিলেটর থাকত। এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ব্যবহারের কারণে কোনো ঘরেই যথেষ্ট বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয় না। সব জায়গায় এখন স্লাইডিং জানালা এবং সব জানালা প্রায় সব সময় বন্ধই থাকে। কিন্তু ঘরে, বিশেষত রান্নাঘরে বায়ু নির্গমনের ব্যবস্থা না থাকাটা বিপজ্জনক। সব মিলিয়ে আমাদের আধুনিক ভবনগুলোর কক্ষ ব্যবস্থাপনা কমবেশি দুর্ঘটনাবান্ধব।

শহরে কিংবা গ্রামে অনেক বাড়িতেই এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। এসব সিলিন্ডারের রেগুলেটরগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে যে-সে যা-তাভাবে রেগুলেটর বানাচ্ছে এবং এর ফলে এখানে-ওখানে দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান তাজা প্রাণ। এ ছাড়া সিলিন্ডার হ্যান্ডলিংও বড় একটা সমস্যা বাংলাদেশে। পরিবহনের সময় সিলিন্ডার যদি ইচ্ছামতো ছুড়ে ফেলা হয়, তাহলে সিলিন্ডারের গায়ে টোল পড়ে। গ্যাসের তীব্র চাপ সহ্য করতে সক্ষম করে তোলার জন্য সিলিন্ডারের অভ্যন্তরের দেয়ালে, বিশেষত গ্যাস নির্গমনপথের কাছাকাছি দেয়ালে যে কার্ব বা কৌণিকতা থাকে, টোল পড়ার কারণে সেই কৌণিকতা কমবেশি নষ্ট হয় এবং এর ফলে সিলিন্ডারের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

একসময় বিদ্যুৎ দুর্ঘটনায় প্রায়ই প্রাণহানি হতো। জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুত্জনিত দুর্ঘটনা তুলনামূলকভাবে কমেছে। গ্যাস দুর্ঘটনা রোধকল্পেও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

শিশির ভট্টাচার্য্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক