ট্রাম্পের বাণিজ্য বিভ্রান্তি

ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম এবং অন্যান্য পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্যিক লড়াই শুরু হয়েছে তা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বহুপক্ষীয়
বাণিজ্যব্যবস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতি
ঘৃণার ফসল।
চীনের তৈরি ৬ হাজার কোটি ডলারের ১ হাজার ৩০০ ধরনের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের
ঘোষণার আগে গত মার্চ মাসের গোড়ার দিকে ট্রাম্প ইস্পাতের ওপর ২৫ শতাংশ এবং অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেন। ট্রাম্প জানিয়েছেন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই তিনি
এমনটা করছেন। তিনি বলেছেন, আমদানি করা ইস্পাতের একটি ছোট অংশের ওপর শুল্ক আরোপ
করা হলে তা প্রকৃত কৌশলগত হুমকি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট হবে।
যদিও বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ ট্রাম্পের এই যুক্তির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইস্পাতের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারকদের দূরে সরিয়ে দিয়ে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তাকে ইতিমধ্যেই হুমকির মুখে ফেলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির একটি সফল আলোচনার শর্ত থেকে কানাডাকে অব্যাহতি দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি না মেনে নিলে কানাডা কার্যকরভাবে হুমকির সম্মুখীন হবে।
কিন্তু ইস্পাত ছাড়া আরও অসংখ্য পণ্য আছে যেমন করাতকল, দুধ ও গাড়ি। কিন্তু ট্রাম্প কি
সত্যিই এই আভাস দিচ্ছেন যে কানাডার সঙ্গে
এই সব ছোটখাটো পণ্যের বাণিজ্য করতে
অপেক্ষাকৃত একটি ভালো চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় নিরাপত্তাকে বলি দেবে? অথবা হয়তো
জাতীয় নিরাপত্তার দাবিটি একেবারেই ভুয়া,
যেমনটা ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং অসংখ্য বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া ট্রাম্পও সেটা বুঝতে পেরেছেন।
প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, ট্রাম্প অতীতের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন। মনে করে দেখুন তো ট্রাম্প একসময় তাঁর সীমানাপ্রাচীর ও মেক্সিকো থেকে
আসা অভিবাসীদের নিয়ে কথা বলতেন, যখন তা ইতিমধ্যে শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছিল।
একই সময় তিনি চীনের বিরুদ্ধে মুদ্রা বিনিময়
হার হ্রাসের বিষয়ে অভিযোগ শুরু করেন, যখন
কিনা চীনা সরকার তার মুদ্রার বিনিময় হার
বাড়িয়ে দিয়েছে।
একইভাবে ট্রাম্প ইস্পাতের ওপর শুল্ক এমন সময় বাড়িয়েছেন, যখন কিনা ইস্পাতের দাম এমনিতেই ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। ট্রাম্প যে কেবল অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তা নয়। তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কেরও ক্ষতি করছেন। আর যাঁরা তাঁকে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে ভালো হওয়ার চেষ্টা করছেন।
ট্রাম্পকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কোনো অর্থনীতিবিদ না থাকলেও তাঁকে এটা বুঝতে হবে যে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি হলে কী ক্ষতি হয়। এটা একটি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতির মতো নয়। চীন থেকে পণ্য আমদানি কমালে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো চাকরির বাজার তৈরি করবে না। তার পরিবর্তে এটা সাধারণ আমেরিকানদের জন্য দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও অন্য কোনো দেশে চাকরির বাজার তৈরি করবে এবং তারা সেসব পণ্য রপ্তানি করার পদক্ষেপ নেবে, যেগুলো আগে চীন রপ্তানি করেছে।
ট্রাম্প চান চীন তার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমিয়ে ফেলুক। ১০০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন তেল বা গ্যাস কেনার মাধ্যমে চীন এটি করতে পারে। তবে চীন যদি অন্য কোথাও থেকে তার কেনা কমাতে পারে বা মার্কিন তেল বা গ্যাসকে অন্য স্থানে বিক্রি করতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবেই মূর্খের মতো।
চীনের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের ১২৮টি রপ্তানি পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে। এই শুল্ক আরোপের ফলে বিস্তৃত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। তবে ট্রাম্পের শক্ত অবস্থান রয়েছে—এমন এলাকায় এর প্রভাব না-ও পড়তে পারে।
আজকের এই বাণিজ্য সংঘাত এই সত্য প্রকাশ করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার প্রভাবশালী অবস্থানটি হারিয়েছে। যখন দরিদ্র, উন্নয়নশীল রাষ্ট্র চীন ২৫ বছর আগেই পশ্চিমাদের সঙ্গে তার বাণিজ্য বৃদ্ধি শুরু করেছিল, তখন অল্প কিছু মানুষই কল্পনা করতে পেরেছিল যে দেশটি একদিন বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটিতে পরিণত হবে। ক্রয়ক্ষমতা সমতার ক্ষেত্র পরিমাপ করা হলে চীন ইতিমধ্যেই উৎপাদন, সঞ্চয়, বাণিজ্য এবং এমনকি জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার অংশের জন্য তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়, যেখানে চীন ততটা নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই চীনকে বড় সুযোগ করে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার
শিল্প বিকাশের এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধাগুলো প্রযুক্তি খাতকে অতিক্রম করে সম্ভবত অর্থনীতির
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রসারিত হবে। স্পষ্টতই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়ন ও
স্থাপনে মান নির্ধারণের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী চুক্তি হওয়া প্রয়োজন।
আগামী বছরগুলোতে আমরা মূলত বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক পছন্দগুলোর সঙ্গে দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী
একটি ‘ন্যায্য’ বাণিজ্য প্রশাসন পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে চিন্তা করতে যাচ্ছি। কিন্তু ট্রাম্প-যুগের
বিপদ হলো, বিশ্ব এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের
টুইটার ফিড দেখছে এবং এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা থেকে বিরত থাকছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে বাস্তব ও কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো চোখের আড়ালেই
থেকে যাচ্ছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ