পশ্চিমাদের কাছে কোনো প্রত্যাশা নয়

লোমহর্ষ ছবিগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। মুখে রক্তমাখা মৃত শিশুদের এসব ছবি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কাছে দুমা এলাকার, যেখানে খোদ দেশটির সরকার নিজ দেশের জনগণের ওপর রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে। যাতে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৭০ জন মানুষ। আহত ব্যক্তির সংখ্যা কয়েক শ।

এ হামলার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মার্টিন অ্যামিস এ ঘটনাকে ‘মানবজাতির জন্য লজ্জাকর’ বলে অভিহিত করেছেন।

২০১৩ সালের আগস্টে সিরিয়ার গৌতা এলাকায় বাশার আল আসাদ সরকার একইভাবে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছিল। সেটাও ছিল একটি লজ্জাজনক ঘটনা।

২০১৫ সালে সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির মৃতদেহের ছবি লজ্জার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরের বছর আলেপ্পোর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার পাওয়া শিশু ওমরান দাকনিশের রক্ত ও ধুলোমাখা মুখের ছবিও আমাদের লজ্জায় ফেলে দেয়।

গত বছরের এপ্রিলে খান শেইকুনে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত ইদলিব গ্রামে সিরিয়ার বিমানবাহিনীর সারিন গ্যাস হামলার ভয়াবহ ভিডিও ফুটেজ স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবেগতাড়িত করে ফেলে।

সে সময় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মার্কিন নীতির ঘোষণা দিয়ে বলেন যে ‘আসাদ পরিবারের শাসনের অবসান হচ্ছে’। তবে আসাদের পৃষ্ঠপোষক রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এটা পছন্দ করেননি।

তবে এ নিয়ে রাগ, ক্ষোভ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পুতিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প তাঁকে অভিনন্দন জানান এবং এই আভাস দেন যে তিনি এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসবেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা সিরিয়া থেকে খুব শিগগির বেরিয়ে আসব।’ সত্যিই প্রেসিডেন্টের মতো কথা বটে!

দুমার এসব লোমহর্ষ ছবি দেখার পর সিরিয়ার দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাম্পের আগ্রহে অবশ্যই ভাটা ফেলবে, অন্তত এখনকার জন্য হলেও। তিনি টুইট করেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন, রাশিয়া ও ইরান এই রাসায়নিক হামলার জন্য দায়ী। কারণ, তারা সবাই পশু আসাদকে সমর্থন দিচ্ছে। এ জন্য তাদের বিরাট মূল্য দিতে হবে।

কিন্তু এ ধরনের হামলা ঠেকাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং তা কত দিনের জন্য? আমি যেটা বুঝতে পারি, জাতিসংঘে এ নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হবে। নিরাপত্তা পরিষদে হয়তো এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাবও পাস হতে পারে এবং এরপর আর কিছুই হবে না। দুমার লোমহর্ষ ছবিগুলো সরে যাবে ডিজিটাল দোকানের জানালাগুলো থেকে। এসব ছবির জায়গা দখল করবে অন্য কোনো ছবি বা কেচ্ছাকাহিনি এবং এ ধরনের হামলার ঘটনা আবার ঘটবে।

গৌতা গণহত্যার পর একটি সময় এসেছিল, যখন আসাদকে একটি টেকসই এবং সমন্বিত সামরিক ও কূটনৈতিক প্রচারাভিযানের মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। একটি দীর্ঘ যুদ্ধবিরতি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে এবং সেখানকার বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সংযত রাখবে। আর এই সুযোগে সেখানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করা যেতে পারে। তখন হয়তো জাতিসংঘের হাজার হাজার শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রয়োজন হবে। তখন সিরিয়ার ভেঙে পড়া অবকাঠামোর পুনর্নির্মাণেরও প্রয়োজন হবে। তবে এটা হবে খুবই কঠিন, দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল।

অনেক কারণে এই কৌশল আর কাজ করে না। এর একটি হচ্ছে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে গৌতায় রাসায়নিক হামলার পর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন জরুরি ভিত্তিতে পাল্টা হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন এড মিলিব্যান্ড তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই ঘটনা আসাদকে নিজ দেশের জনগণের ওপর হামলা চালাতেই উৎসাহিত করেছে।

কিন্তু আমরা কেন এমনটি হতে দিচ্ছি? আমাদের নিশ্চয়ই অনেক কিছু করার আছে। এভাবে চুপ করে যে থাকা উচিত নয়, সেটা তো সবার বোঝা উচিত।

আমি নিজে হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত আন্তর্জাতিক আইনের ‘সুরক্ষার জন্য দায়িত্ব’ মতবাদের আমি ঘোর সমর্থক। ওই মতবাদ অনুযায়ী গণহত্যা বন্ধে যৌথ শক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আমি মনে করি, ধনী দেশগুলোর উচিত শরণার্থীদের গ্রহণ করা।

কিন্তু বিশ্ব কেবলই এই সব বিষয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাই নয় কি? পশ্চিমের দেশগুলো এখন নিজেদের মধ্যে দেয়াল তুলছে, ইউরোপীয়
ইউনিয়ন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করছে, গণতন্ত্রকে হটিয়ে দিচ্ছে।

কাজেই দুমা হামলার ঘটনায় বিশ্ব বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেবে, এমনটা প্রত্যাশা না করাই ভালো। দুমার মৃত শিশুদের ছবি দেখে আমাদের বিবেক হয়তো মুহূর্তের জন্য জেগে উঠেছে। কিন্তু ভাবনার কিছু নেই, আমরা সবকিছু আবার ভুলে যাব। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।

ম্যাথিউ ডিআনকোনা গার্ডিয়ান পত্রিকার কলাম লেখক