দুদকের হাত-পা বাঁধার মতো কেউ নেই

ইকবাল মাহমুদ
ইকবাল মাহমুদ

ইকবাল মাহমুদ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: হাইকোর্ট আপনাকে বারবার তিরস্কার করা সত্ত্বেও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে কেন আসামি করছেন না? কেন চার্জশিট দিচ্ছেন না? যদিও ব্যাংকের ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আদায় করেছেন, কিন্তু বিচার এড়িয়ে টাকা আদায় করার ম্যান্ডেট আপনাকে কে দিয়েছে?
ইকবাল মাহমুদ: বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলো তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। আপনারা দেখছেন, বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে বারবার তদন্তকারী কর্মকর্তারা দুদকে তলব করছেন এবং তিনিও আসছেন। দুদক অভিযোগের তদন্ত করে, টাকা আদায় দুদকের দায়িত্ব নয়, এ বিষয়ে দুদক সচেতন। কিন্তু দুদকের কারণে এত টাকা আদায় হওয়ার খবর যখন বেরোয়, তখন এই সমাজের মানুষ হিসেবে আমরা তা দেখি। এ-জাতীয় দুর্নীতির ফল হচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। দুদকের হস্তক্ষেপে কেউ যদি আত্মসাৎ করা টাকা জমা দেন, তাহলে দুদকের কিছু করার নেই। তবে ফৌজদারি অপরাধের আইনি কার্যক্রম দুদক জানে। ম্যালাফাইডি বা বোনাফাইডি ভুলের বিষয়টিও দুদক জানে। দুদক আইনানুগ প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কিছুই করছে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না।

প্রথম আলো: কিন্তু আদালত বলার আগ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিষয়ে আপনি নীরব ছিলেন।
ইকবাল মাহমুদ: আদালত যেসব পর্যবেক্ষণ দেন সেসব আমরা দেখি। কিন্তু সব সময় এটা সত্য নয় যে আদালত বলার পরেই কেবল আমরা কিছু করেছি।

প্রথম আলো: সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ যেসব কেলেঙ্কারি হয়েছে, পর্ষদ সদস্যরা কীভাবে পার পাচ্ছেন? রাজনৈতিক নিয়োগ বলেই কি?
ইকবাল মাহমুদ: এই প্রশ্ন এখন আমাদের করলে তার উত্তর দেওয়া কঠিন। আগের কমিশন তদন্ত করেছে, মামলাগুলো বিচারাধীন। বেশ কয়েকজন কারাগারে। আমাদের এখন দায়িত্ব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করা। বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় ৫৯টি মামলা হয়েছে। প্রতিটি টাকা কোথায়, কীভাবে, কখন এবং কোন ব্যক্তির পকেটে গিয়েছে, তার তদন্ত চলছে। ফৌজদারি দায় নিরূপণ না করে আবেগ এবং ধারণা করে কাউকে আসামি করার সুযোগ নেই। কে কীভাবে ব্যাংক বোর্ডে নিয়োগ পেয়েছেন, তা বিবেচ্য নয়।

প্রথম আলো: বেসিক ব্যাংকের অর্ধেক টাকার জন্য মামলা করেছেন। বাকি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার জন্য মামলা করবেন কবে?
ইকবাল মাহমুদ: সেটা হবে। হুট করে মামলা করা অসুবিধাজনক। পত্রিকায় বহু কিছু আসতে পারে, কিন্তু আমাকে প্রমাণ করার মতো করে মামলা করতে হবে। অনুসন্ধান শেষে আমাদের পাইপলাইনে আরও ১০টি মামলা আছে।

প্রথম আলো: আবদুল হাই বাচ্চু ঘুষ নিয়ে ঋণ দিয়েছেন-এমন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকার পরও তিনি কেন আজও মামলার বাইরে? পক্ষপাতিত্ব?
ইকবাল মাহমুদ: তদন্ত সম্পন্ন হলেই সব প্রশ্নের জবাব পাবেন। তবে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি কিন্তু আমি কোর্টে প্রমাণ করতে পারব না। ফাঁদ পেতে ধরা ছাড়া ঘুষের মামলা প্রমাণ করা খুব কঠিন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক কী করছে? দুদক যা ছোঁবে না, তা অন্যরা ছুঁতে পারবে না? এখতিয়ার থাকতেও যথাব্যবস্থা যারা নেয় না, সেটা দুর্নীতি নয়? আইন কি সবাইকে দুদকের মুখাপেক্ষী করেছে?
ইকবাল মাহমুদ: সবারই সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছে। যখন এসব ঘটে, তখনই তো বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব তা নিরীক্ষা করা, দেখা এবং বন্ধ করা। কত সন্দেহজনক লেনদেন হচ্ছে, কিন্তু সেসব তো আমাদের কাছে রেফার করতে হবে। সবাই যদি সবার দায়িত্ব পালন না করে...।

প্রথম আলো: সাংবিধানিকভাবে মহাহিসাব নিরীক্ষক সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনো সরকারি সংস্থার প্রতিটি নথিপত্র স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করতে পারেন। এ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে আপনি কী পেয়েছেন?
ইকবাল মাহমুদ: দু-তিনটির বেশি নয়।

প্রথম আলো: কিন্তু তার একটিও কি তেমন গুরুত্বপূর্ণ?
ইকবাল মাহমুদ: হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো: দয়া করে উদাহরণ দিন। আমাদের মহাহিসাব নিরীক্ষক কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনার নজরে এনেছেন।
ইকবাল মাহমুদ: যেমন বিদেশি মিশনে পাসপোর্টের টাকা জমা না দেওয়া। কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তার (জনাব মাকসুদ) বিরুদ্ধে চার লাখ ডলার তছরুপের একটি মামলা হয়েছে।

প্রথম আলো: পর্ষদ সদস্যরা মুক্ত থাকবেন, ব্যবসায়ীরা জামিনে, ব্যাংকাররা হাজতে থাকবেন। আপনি বলবেন, এসবে আপনার দায় নেই, তাহলে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে কেন?
ইকবাল মাহমুদ: যদি কেউ জামিন পান কিংবা মুক্তি পান, দুদক প্রথাগতভাবেই আপিলসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করে। সাধারণভাবে কেউ জামিন পেলে আমরা উচ্চ আদালতে যাই। এখন কে বাইরে থাকবেন, কে হাজতে থাকবেন, সেটা তো আমাদের বিষয় নয়। তবে হ্যাঁ, আপনার কথা সঠিক যে বিচার বা বিশ্বাসের বিষয়টি শুধু দুদকের ওপর নির্ভর করে না। এটা অনেক অংশীজনের কাজের ওপর নির্ভর করে। শুধু দুদককে দুষলে তো হবে না, এর সঙ্গে অনেকেরই...।

প্রথম আলো: তাই যদি হবে, তাহলে আপনি সেদিন কীভাবে বললেন যে সুশাসনের উন্নতি ঘটেছে বলেই ব্যাংক কেলেঙ্কারি কমেছে? দুই বছর আগে যারা ক্ষমতায় ছিল, এখনো তারাই আছে, তাহলে?
ইকবাল মাহমুদ: এখন কিন্তু সে রকম কেলেঙ্কারির কথা পত্রিকাগুলো প্রকাশ করতে পারছেন না।

প্রথম আলো: এই সেদিন খবর বেরোল, কী করে একটি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংকের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পেল।
ইকবাল মাহমুদ: দেখেছি। ঋণ দেওয়া এবং ঋণ নেওয়া তো পাপ নয়।

প্রথম আলো: অবশ্যই। কিন্তু প্রয়োজনীয় বৈধ দলিলপত্রের ভিত্তিতে কি না? হল-মার্কও কাগজপত্র দেখিয়েই ঋণ নিয়েছিল।
ইকবাল মাহমুদ: সেসব দেখা হচ্ছে। সুশাসন বেড়েছে বলার কারণ হলো ঋণের প্রবাহ ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এখন নেই। গত দুই বছরে প্রায় সব বোর্ডে পরিবর্তন এসেছে।

প্রথম আলো: দুদককে দায়মুক্তির কমিশন হিসেবে কটাক্ষ করা হতো। সেটা কাটাতে আপনি উদ্যোগ না নিতেই আবারও সেই অভিযোগ...।
ইকবাল মাহমুদ: আমি প্রথম দিনেই বলেছিলাম, দুদক হবে দুর্নীতিবাজদের আতঙ্ক এবং সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল। গত দুই বছরে প্রায় ৬০০ ব্যক্তিকে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার এবং গত বছর রেকর্ডসংখ্যক ২৪টি ঘুষসংক্রান্ত ফাঁদ মামলা পরিচালনা করা হয়েছে। এমনকি এ দেশে প্রথমবারের মতো দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা নগদ টাকা উদ্ধার করেছি। দুদকের মামলায় সাজার হার মাত্র ২০ শতাংশে নেমে এসেছিল, তা আজ প্রায় ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর অনেক তদন্তকারী সংস্থার চেয়েও দুদকে মামলার সাজার হার সন্তোষজনক। তাই আগের মতো অবস্থা হতে চলেছে বলাটা সম্পূর্ণ ভুল। বিত্তবান, কম বিত্তবান সবাইকে গ্রেপ্তার করেছি।

প্রথম আলো: কিন্তু তাতে ক্ষমতাসীন দল বিব্রত হতে পারে, পাওয়ারফুল এমন কেউ আছেন কি?
ইকবাল মাহমুদ: পাওয়ারফুল নেই, মানে কী?

প্রথম আলো: আপনার ফাঁদ মামলার সবাই চুনোপুঁটি।
ইকবাল মাহমুদ: সাধারণ মানুষ হয়রানি হয় কিন্তু এই চুনোপুঁটির কাছেই, তারাই স্ট্রিট লেভেল ব্যুরোক্রেসিতে বেশি। আপনার সম্পাদকের কাছে কজন লোক যেতে পারেন? আর আপনার কাছে কজন যেতে পারেন? আর সংবাদকর্মী যাঁরা মাঠে কাজ করেন, তাঁর কাছে কজন যেতে পারেন? আপনি যেটা বলেছেন, সেটা আমি মানি না। কারণ, আমরা ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে, তাঁকেও ধরেছি। ৫ হাজার টাকাও ধরেছি। শিক্ষার উপপরিচালক, মহাপরিচালককে ধরেছি।

প্রথম আলো: ফারমার্স ব্যাংকের মূল ব্যক্তি মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তাঁকে বাদ দিয়ে ১৭ জনের বিদেশভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এমনটা কেন ঘটল? মানুষ এই বৈষম্যটা দেখছে।
ইকবাল মাহমুদ: মানুষ দেখুক, এতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। সাধারণত তদন্তকারীরা, যাঁদের পালানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাঁদের বিদেশভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনি ঘটেছে। আপনি কি মনে করেন, একজন অত্যন্ত পরিচিত লোক, আপনি ভ্রমণ কখন বন্ধ করেন? আপনি উচ্চপদস্থ একজন লোকের ভ্রমণ কী কারণে বন্ধ করবেন? তিনি কোথায় পালাবেন? মহীউদ্দীন খান আলমগীর মামলায় আসবেন কি না, তা আমি জানি না। আপনিও জানেন না।

প্রথম আলো: বিএনপির ৮ নেতার বিরুদ্ধে খবর বেরোতেই দুদক মামলা ঠুকল। বিরোধী দল বলে তাঁরা নিশ্চয় পার পাবেন না। কিন্তু সরকারি দলের অনেক রাঘববোয়াল পার পাচ্ছেন কি না?
ইকবাল মাহমুদ: দুদক এখন আর পিক অ্যান্ড চুজ করে না। অভিযোগ গ্রহণের গ্রেডিং পদ্ধতির বেঞ্চমার্ক পেয়েছে বলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। কেউ কৌশলগত কারণে দুদকের সমালোচনা করেন, আবার কেউ করেন না। এখানে রাজনীতির কথা না আনাটা সমীচীন। একটি পত্রিকায় দেখলাম, রাজনীতিকেরা আতঙ্কিত। অনুসন্ধান পর্যায়ে কারও আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। আপনি দায়িত্ব পালনে যদি অনিয়ম না করেন, তাহলে আতঙ্কিত কেন হবেন, আমি এই প্রশ্নের উত্তর পাই না।

প্রথম আলো: কিন্তু বিরোধীরা তো হাই-প্রোফাইলে নেই। লো-প্রোফাইল মামলার বেশি গতি সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?
ইকবাল মাহমুদ: মামলার গতি একটি আইনি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় দুদক একটি অংশমাত্র। দুদক এ দায়িত্ব পালনে নির্মোহ। প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে দুদক যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে।

প্রথম আলো: দুই বড় দল-সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির মামলা দায়ের ও চলমান থাকা বিষয়ে যে বৈষম্য প্রতীয়মান হচ্ছে, তা কি কাকতালীয়?
ইকবাল মাহমুদ: আপনি একটি মামলা দেখাতে পারবেন, যা আমরা প্রত্যাহার করেছি? আমার মুখ দিয়ে আমি কোনো রাজনীতিকের নাম বলতে চাই না। আমরা মূলত দুর্নীতি বা অভিযোগটা দেখি।

প্রথম আলো: ১/১১-তে দায়ের করা সব মামলাই কি চলমান? আপনাদের কাছে কোনোটিই কি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় নেই?
ইকবাল মাহমুদ: আপনি আমার টেবিলের দিকে তাকান। আপনি কি কখনো দেখেছেন, আমার টেবিলে ফাইল পড়ে আছে?

প্রথম আলো: আপনি হয়তো বলবেন, আপনার হাত-পা বাঁধা. .
ইকবাল মাহমুদ: না, আমার হাত-পা বাঁধা নেই। দুদকের হাত-পা কে বাঁধবে? এ কথা তো ঠিক নয়। দুদকের হাত-পা বাঁধার মতো কেউ তো নেই।

প্রথম আলো: নাইকো মামলা বিষয়ে কী বলবেন?
ইকবাল মাহমুদ: সেটা চলমান।

প্রথম আলো: চলমান, সেটা বিএনপির অংশ, সরকারি দলের অংশ চলছে না।

সাক্ষাৎকার গ্রহণের এ পর্যায়ে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে খবর এল, ১০ লাখ টাকার প্লট শ্বশুরের নামে দেওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কুতুব উদ্দিন আহমেদ গ্রেপ্তার হয়েছেন। ]
ইকবাল মাহমুদ: কুতুব সাহেব কে চেনেন কি?

প্রথম আলো: দুদক এখন পর্যন্ত সচিবালয়ের অভ্যন্তরের কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এই কুতুব সাহেবও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তামাত্র। সচিবালয়ে কর্মরতদের দণ্ড দেওয়ার পর্যায়ে একজনকেও নিতে পারেনি দুদক।
ইকবাল মাহমুদ: দণ্ড পর্যন্ত যেতে একটু সময় লাগবে। তবে উপসচিব পর্যায়ের গ্রেপ্তার হয়েছে।

প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন দলীয় তেমন কারও বিষয়ে এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ আপনাদের হাতে কি একটিও নেই, যার আওতায় অনুসন্ধান পর্যায়ে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন?
ইকবাল মাহমুদ: অনুসন্ধান হচ্ছে অভিযোগ তদন্তের প্রাথমিক অবস্থা। অভিযোগের আপাতগ্রাহ্য ভিত্তি থাকলে তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। অন্যথায় ঢালাওভাবে অনুসন্ধান পর্যায়ে গ্রেপ্তার করা হলে সমাজে ভুল বার্তা চলে যেতে পারে। নির্দোষ মানুষও হয়রানির শিকার হতে পারেন। এ বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে।

প্রথম আলো: তথ্য গোপন করার দায়ে আপনি এ পর্যন্ত কতজন সাংসদের বিরুদ্ধে ইসিকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন? কী ফল?
ইকবাল মাহমুদ: একজনের বিষয়ে। আমি যদ্দুর জানি, ইসি কিছু করার আগেই মামলা হয়ে গেছে।

প্রথম আলো: দুর্নীতি দমনের পথ পরিহার করে প্রতিরোধের দিকে জোর দিতে নানা সেমিনার ও প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে-এই সমালোচনা আপনি কীভাবে খণ্ডন করবেন?
ইকবাল মাহমুদ: দুদক আইনের ১৭ ধারায় বর্ণিত দুদকের ১১টি কার্যক্রমের মধ্যে ৬টিই দুর্নীতি প্রতিরোধের আওতাভুক্ত। সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ জাগাতে যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, তা কমিশনের আইনি ম্যান্ডেট।

প্রথম আলো: অর্থ পাচারের বিষয়ে দুদক কী করছে? পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারসে অনেকের নাম এসেছে। আপনারা এখানে ১০ লাখ টাকার ফাঁদ ধরছেন। আর গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে এসেছে, ১০ বছরে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
ইকবাল মাহমুদ: দুদক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুসারে দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধনের পর বেসরকারি ব্যক্তিদের মানি লন্ডারিং অভিযোগ অনুসন্ধানের মূল দায়িত্বে আছে সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ এবং এনবিআর। তদুপরি দুদক এগুলো অনুসন্ধান করছে। বিভিন্ন দেশে এমএলএআর পাঠানো হচ্ছে। ট্রেডবেইজড মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দুদক এ বছর বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ বিদেশে বিনিয়োগ করছে বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। আইন অনুযায়ী এর সুযোগ নেই। দুদক কি এ বিষয়ে কিছু করেছে?
ইকবাল মাহমুদ: এ বিষয়টি আমার জানা নেই, তাই কোনো মন্তব্যও নেই।

প্রথম আলো: জানা নেই কিন্তু জানার চেষ্টা করেছেন কি?
ইকবাল মাহমুদ: এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যু। আমার ইস্যু তো নয়। বিনিয়োগ করবেন কি করবেন না, করলে কীভাবে করবেন, তা আমার বিষয় নয়।

প্রথম আলো: আপিল বিভাগের রায় বলেছে, আপনি ব্যাংকের তথ্য চাইলেই তারা দেবে। সেটা কি কখনো প্রয়োগ করেছেন?
ইকবাল মাহমুদ: বিষয়টি অতটা সহজ নয়। চাইলেই তারা দেয় না। তারা ব্যাংকিং আইনসহ বহু কিছু দেখায়।

প্রথম আলো: ট্যাক্স নেট বাড়াতে আপনার প্রস্তাবের কী হলো?
ইকবাল মাহমুদ: জানি না। তবে ট্যাক্স ও জিডিপির অনুপাত ২২ শতাংশ হওয়ার পরিবর্তে ৮ শতাংশ থাকা লজ্জাজনক। কর আদায় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। করের হার কমাতে হবে।

প্রথম আলো: দুদকে যাঁরা আছেন, তাঁদের আয়কর রিটার্ন পরীক্ষা করেন কি?
ইকবাল মাহমুদ: না।

প্রথম আলো: আপনি এবং আপনার কমিশনারদের আয়কর বিবরণী ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা সম্ভব?
ইকবাল মাহমুদ: সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, আপনি যদি একটি জনপ্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি করেন, তাহলে তো দেশের কাজে অসুবিধা হবে। ইউএনও-ডিসিদের নিয়ে বসেছিলাম। ১২ লাখ সরকারি কর্মচারীর সম্পদের বিবরণী চাওয়া ও তার ব্যবস্থাপনার কী হবে? ভারতও এটা পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে, আয়কর রিটার্ন দিলে সম্পদের বিবরণী কেন চাইবেন? আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসংগতি দেখে দুদকের একজন সহকারী পরিচালক চাকরিচ্যুত হয়েছেন।

প্রথম আলো: সব মন্ত্রীর আয়ের সঙ্গে ব্যয় সংগতিপূর্ণ কি? তাঁদের কেন ধরছেন না? সাবেক মন্ত্রীরাই আপনার আকর্ষণ?
ইকবাল মাহমুদ: আমাকে তো জানতে হবে। আমাকে কি আপনি জানিয়েছেন, কোন মন্ত্রীর আয়-ব্যয়ে কী সমস্যা? আপনারা পত্রিকা চালান। আপনাদের পত্রিকায় মন্ত্রীদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখি না। কোন মন্ত্রী দুর্নীতিবাজ, তা তো লেখেন না। বলুন?

প্রথম আলো: দুদকের প্রধান হিসেবে মন্ত্রীদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির বিষয়ে আপনার ধারণা বলুন। মিডিয়ায় কোনো ইঙ্গিতই কি ছাপা হয়নি?
ইকবাল মাহমুদ: আমি নাম বলতে চাই না। কয়েকজন অনুসন্ধান বা তদন্তের আওতায় রয়েছেন, সেটা হয়তো আপনাদের অজানা।

প্রথম আলো: এই মন্ত্রীদের বিচারের প্রক্রিয়া কবে শুরু হতে পারে?
ইকবাল মাহমুদ: এটা বলা মুশকিল। টাইমলাইন বেঁধে দেওয়া মুশকিল। তথ্য সঠিকভাবে না পেলে আমি তাঁদের প্রসিকিউট করতে পারব কি পারব না, সেটা বলতে পারছি না।

প্রথম আলো: কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র বা বিদেশে আপনার বা পোষ্যদের কোনো বাড়ি বা সম্পদ আছে কি?
ইকবাল মাহমুদ: আমার বা আমার পোষ্যদের বিদেশে কোনো বাড়ি বা সম্পদ নেই। ঢাকায় বাড়ি আছে, তা-ও সরকারি প্লট। সেটা ডেভেলপারকে দিয়ে পাওয়া চারটি ফ্ল্যাটের দুটি বিক্রিও করেছি। মেয়ে ও ছেলের নামে একটি করে ফ্ল্যাট দিয়েছি।

প্রথম আলো: আপনার সম্পদের বিবরণী ওয়েবসাইটে প্রকাশে আইন আপনাকে বাধা দিচ্ছে?
ইকবাল মাহমুদ: না।

প্রথম আলো: তাহলে আপনি ও আপনার কমিশনাররা কি এটা প্রকাশ করে একটি উদাহরণ তৈরির চিন্তা-ভাবনা করবেন?
ইকবাল মাহমুদ: চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। কিন্তু সেটা আমি করব না। আমি একা চলতে চাই না। আমি দিলাম, এরপর একটা হইচই শুরু হলো, তাহলে অন্যদের ওপর চাপ তৈরি হবে। আমার ধারণা, তাহলে জনপ্রশাসনই নয়, ব্যবসায়ীরাও হইচই শুরু করবেন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইকবাল মাহমুদ: ধন্যবাদ।