ব্রাজিলের গণতন্ত্র কি টিকবে?

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভা
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভা

৭ এপ্রিল ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভা দুর্নীতির জন্য ১২ বছর ১ মাসের কারাভোগ শুরু করার জন্য ফেডারেল পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বিচারক সার্জিও মোরো শুক্রবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে ডি সিলভাকে আত্মসমর্পণের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আত্মসমর্পণ করার আগে ডি সিলভা তাঁর পক্ষ থেকে একটি শর্ত দেন। শর্তটি হচ্ছে, তাঁর মৃত স্ত্রী মারিসা লেটিসিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সম্মানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পরই কেবল তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। 

শুধু তা-ই নয়, আত্মসমর্পণ ও দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুরিটিবার কারাগারে পাঠানোর আগ পর্যন্ত ডি সিলভা আরও অনেক কিছুই করেছেন, যাঁকে রাজনীতির খেলা বলা চলে। তিনি দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন, তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে। গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আবারও বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনের জনপ্রিয় প্রার্থীকে জেল দিলে তা কেবল ব্রাজিলের গণতন্ত্রকেই দুর্বল করবে।
ডি সিলভা তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে দিয়েই এর শেষ হবে না। তবে আমি এখন আর কোনো মানুষ নই। আমি এখন একটি ধারণা। সেই ধারণা, যা আপনাদের সব ধারণার সঙ্গে মিশে গেছে। এ সময় ভিড়ের মধ্য থেকে অনেকে বলেন, আত্মসমর্পণ করবেন না। এ সময় ডি সিলভার সমর্থকেরা গোটা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন।
লুলা ডি সিলভাকে দোষী সাব্যস্ত এবং তাঁর কারাবাস ব্রাজিলের রাজনৈতিক সংকটকে আরও উসকে দিয়েছে। এখন এটা পরিষ্কার নয় যে ১৯৮৫ সালে স্বৈরতন্ত্রের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া দেশটিতে গণতন্ত্র টিকে থাকবে, নাকি স্বৈরতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী সরকারের সমর্থকেরাই ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হবে।
ব্রাজিলের ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট লুলা ডি সিলভার হেবিয়াস করপাস আবেদন খারিজ করার আগের দিন ৪ এপ্রিল দেশটির সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এদুয়ার্দো ভিলাস বাওস টুইটারে দেওয়া এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে যেন স্বৈরতন্ত্রের ভূতকেই ডেকে আনলেন। ওই ঘোষণায় তিনি বলেন, সেনাবাহিনী তার মিশনগুলোর ব্যাপারে যত্নবান এবং সব নাগরিকের উচিত দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। জেনারেল এদুয়ার্দোর এই ঘোষণাকে অনেকেই সিলভাকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আদালতকে বাধ্য করার উদ্যোগ হিসেবে মনে করেন। দেশটির আরেক জেনারেল লুইজ গোনজাগা শ্রোয়েডার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যদি সিলভা আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা।
এই উভয় জেনারেলই মনে করেন যে ডি সিলভার প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে অসম্মান করা। ২০১৪ সালে সরকারের পরিষেবাগুলোতে ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়। তখন এ নিয়ে ব্রাজিলের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক তোলপাড় হয়। তাই সেদিক থেকে সিলভার এই কারাভোগ ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। তবে তার মানে এই নয় যে ব্রাজিলের রাজনৈতিক সংকটের অবসান হয়েছে। বরং আগামী মাসগুলোতে কী ঘটবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
জনমত জরিপ অনুযায়ী লুলা ডি সিলভা এখনো শীর্ষ পছন্দের প্রার্থী এবং তিনি তাঁর কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন এবং অক্টোবরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির একজন প্রার্থীও হতে পারবেন। এ ছাড়া তিনি জেলের ভেতর থেকেও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত তাঁকে ‘ক্লিন স্লেট’ আইনের আওতায় অযোগ্য ঘোষণা না করেন। ওই আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না।
তবে সিলভার অনুকূলে যদি কিছুই না যায়, তাহলে তা ব্রাজিলের বামপন্থীদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তখন তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, তাদের সুনাম নষ্ট হবে, এর সদস্যরা বিভক্ত হয়ে পড়বেন এবং তাঁদের আর কোনো শক্ত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থাকবে না।
ডি সিলভার কারাবাসে কি দেশটির গণতন্ত্রের জন্য কিছু অর্জিত হবে? আমরা এখনো তা জানি না। আমরা জানি না তাঁর এই পতনে দেশটির সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী জাইর বলসোনারোর আদৌ কোনো লাভ হবে কি না। জনমত জরিপে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন বলসোনারো। তবে তাঁর মুখে ব্রাজিলের স্বৈরতন্ত্র যুগের নির্যাতনকেন্দ্রের সাবেক প্রধানের অব্যাহত প্রশংসায় ইতিমধ্যে অনেক ব্রাজিলীয়র মনে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এদিকে ব্রাজিলে রাজনৈতিক সহিংসতাও বেড়েছে। গত ২৯ মার্চ সিলভা দক্ষিণাঞ্চলীয় পারানা রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালানোর সময় তাঁর গাড়িবহর লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। তাঁর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ভূমিহীন শ্রমিক আন্দোলন ১১টি রাজ্যে সড়ক অবরোধ করে। শনিবার ডি সিলভার আত্মসমর্পণের খবর সংগ্রহের সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, সরকার যখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারায়, তখন তা রাজনৈতিক ক্ষমতালোভীদের জন্য সবুজসংকেত হয়ে দেখা
দেয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে বা গণদাঙ্গা দেখা দিলে তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যারা ধ্বংস করতে চায় তাদের ক্ষমতা দখলের এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দেয়। এ রকম যদি ঘটে, তাহলে বলব যে ব্রাজিলের অতীত যদি অন্ধকার হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ হবে ঘোর অন্ধকারময়।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ক্যারল পাইরেস রাজনৈতিক প্রতিবেদক ও নিউইয়র্ক টাইমস-এর নিয়মিত প্রদায়ক