পাহাড়ে বিঝু উৎসব ও শান্তির অন্বেষা

বিঝু উৎসবে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি তরুণ–তরুণীরা
বিঝু উৎসবে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি তরুণ–তরুণীরা

চৈত্র মাস এলেই কোকিলের ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাহাড়ের ছোট-বড় সবাই বছরের এই কাঙ্ক্ষিত উৎসবের জন্য দিন গুনতে থাকে। এই উৎসবের আয়োজন বেশি কিছু নয়, শুধু বিভিন্ন পদের সবজির সমাহার, যার নাম ‘পাজন’ বা ‘পাচন’। সারা বছর তো আমরা সবজির তরকারি খাই, কিন্তু বিঝু, বৈসু বা সাংগ্রাইয়ের দিনে রান্না করা সবজির তুলনা যে বছরের অন্যান্য ৩৬৪ দিনের মতো হয় না। সে জন্যই বিঝুর অন্যতম আকর্ষণ হলো এই ‘পাজন’।

এবারের বিঝু উৎসব লংগদুর ঘরপোড়া মানুষের জন্য আনন্দের পরিবর্তে বিষাদই বয়ে আনবে।

গত বছরের ২ জুন মোটরসাইকেলচালক নুরুল ইসলামের লাশ উদ্ধারের পরে পাহাড়িদের গ্রামে সহিংস হামলা চালানো হয়। প্রায় ২১৩টি পাহাড়ি বসতভিটায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

১০ মাস যাবৎ ঘরপোড়া পরিবারের লোকেরা কঠিন জীবনসংগ্রামের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে সরকারিভাবে পরিবারপ্রতি মাসিক ৩০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বাড়ি নির্মাণের জন্য সরকারিভাবে আশ্বাস দেওয়া হলেও ১০ মাসে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করেও কোনো ঠিকাদার পাওয়া যায়নি! কেউ টেন্ডার না নেওয়ায় বাড়ি নির্মাণের কাজও হচ্ছে না! কী বিচিত্র অজুহাত। এতগুলো পরিবার ১০ মাস যাবৎ মাথার ওপর চাল নেই, চুলো নেই অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। সামনে বর্ষাকাল। ওই সময়ে অবস্থা কী দাঁড়াবে!

যাদের মাথার ওপর চাল নেই, চুলো নেই, তাদের কাছে ‘বিঝু উত্সব’ বাতুলতামাত্র। বিঝু এখন তাদের কাছে ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’! ছোট বাচ্চাদের নতুন কাপড় দেওয়া দূরে থাক, একটুখানি ‘পাজন’ মুখে তুলে দেওয়ার সাধ্যও যে বাবা-মায়েদের আজ নেই!

পাহাড়ে বিঝু, বৈসু বা সাংগ্রাইয়ের আমেজ বিষাদে ঢেকে যাওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হচ্ছে। ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যার পর সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎসবের আমেজ মুহূর্তেই উবে যায়। সে বছর বিঝুর দিনে লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল।

শুধু বিঝুর আগে নয়, বিঝুর আমেজ মিলিয়ে যেতে না যেতেই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। পেছনে ফিরে তাকালে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল রাঙামাটির সাজেকে চারটি গ্রামের প্রায় ৭৭টি পাহাড়ির বসতভিটা, একটি গির্জা, ইউনিসেফ পরিচালিত দুটি স্কুল জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা।

২০১০ সালের ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি আবারও সাজেকে সাম্প্রদায়িক সহিংস হামলার ঘটনায় ১১টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি, দুটি বৌদ্ধমন্দির ও একটি গির্জা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

সাজেক সহিংসতার দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরের পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা মাজনপাড়া ও সাতভাইয়ায় হামলা চালিয়ে কমপক্ষে আরও ৬০টি বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির রামগড় ও মানিকছড়িতে একযোগে হামলা করা হয়।

এই হামলার ঘটনায় মিইপ্রু নামের এক কিশোরীর রক্তাক্ত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে ঘটনাটি দেশে ও বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিঝুর আগে ও পরে সংঘটিত অতীতের ঘটনাগুলো পর্যালোচনার পরে সবার মনে একটাই প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয়, তা হলো এবারের বিঝু উৎসব সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা যাবে তো?

চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন ও পয়লা বৈশাখ নিয়ে পাহাড়ের বিঝু উত্সব উদ্যাপিত হয়।

বৈসু, সাংগ্রাই, বিঝু-যে নামেই অভিহিতকরা হোক না কেন, এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্যই হলো পুরোনো বছরের সব গ্লানি, হিংসা-বিদ্বেষ, দুঃখকে ঝেড়ে ফেলে নতুন বছরে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। এই উৎসবে ধর্মীয় গোঁড়ামির স্থান নেই। সব সম্প্রদায় ও শ্রেণির মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রচনা করে এই উত্সব।

বিঝু উৎসব পাহাড়ে যেমন অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগিয়ে তোলে, তেমনি সারা বাংলায় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আবহমান বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিতকে করে তোলে আরও মজবুত।

ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার-এই স্লোগান যেন কেবল স্লোগান হয়ে না থাকে, সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতি এই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। লংগদুর ঘরপোড়াবাসীর মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব এই সরকার ও রাষ্ট্রের।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে শুভ হোক বিঝু উৎসব।

ইলিরা দেওয়ান : হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
ilira. dewan@gmail. com