সিরিয়াকে ঘিরে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ছড়াতে পারে

এএফপি ফাইল ছবি
এএফপি ফাইল ছবি

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে নিশ্চিতভাবেই মনে হচ্ছে, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিশন দ্রুত শেষ হতে যাচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে সেই দেশের দীর্ঘ সাত বছরের গৃহযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের সুযোগও শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনী গত সপ্তাহে বিদ্রোহী অধিকৃত পূর্ব গুতা অঞ্চলের দুমা এলাকায় রাসায়নিক হামলা চালায়। এ ঘটনা দেখিয়েছে, সিরিয়া ও পৃথিবীর জন্য কতখানি বিপদ অপেক্ষা করছে।
এই রাসায়নিক হামলার প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং সিরিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন, তা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং সিরিয়ায় যে তাঁর সত্যিকার অর্থে কোনো কৌশল নেই, তা প্রকাশ পেয়েছে। আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে এক বা দুটি আক্রমণের আদেশ দিয়ে না সেখানে তাঁর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, না যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে ট্রাম্পের অবস্থান উন্নত হবে।
ট্রাম্পের শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টারা সিরিয়ায় মোতায়েন দুই হাজার সেনাকে রেখে দেওয়ার জন্য ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের অবশিষ্ট ক্ষুদ্র অংশকে নির্মূল করার পরিকল্পনা সীমিত করেছেন, যা করতে মাত্র ছয় মাস সময় লাগবে।
এভাবে কার্যক্রম সীমিত করে দিয়ে ট্রাম্প সিরিয়ার ভবিষ্যৎ গঠনের সুযোগকে হাতছাড়া করে ফেলছেন। ফলে ট্রাম্পের শত্রু-মিত্র সবার মাঝে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বনেতার পদটি আর যুক্তরাষ্ট্রের দখলে নেই।
এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সিরিয়ায় ট্রাম্পের একমাত্র যে লক্ষ্য, তা অর্জনও ব্যাহত হবে। ট্রাম্পের সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে আনার ঘোষণা এই ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। বাশার আল-আসাদ ইতিমধ্যে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন নিয়ে যেকোনো মূল্যে বিদ্রোহী অধিকৃত এলাকা পুনরায় দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস অনুভব করা শুরু করেছেন। এটা করতে সফল হলে আসাদ ও তাঁর মিত্ররা বিশ্বের সামনে নিজেদের দুর্বার ও শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেন। এবং
বিদ্রোহীদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া ছাড়াই আসাদ ক্ষমতায় থাকবেন।
স্থানীয় ও আঞ্চলিক নেতারা, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের রক্ত দিয়ে এর মূল্য দিতে হবে। বিশেষ করে কুর্দিরা। তারা আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিলে তারা আক্ষরিক অর্থেই বিপদে পড়বে, যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করেছেন যে সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে কুর্দিরা সুরক্ষার জন্য আসাদের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হতে পারে। এরই মধ্যে শত শত কুর্দি যোদ্ধা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াই ছেড়ে পালিয়েছে। তরুণ কুর্দিদের অনেকেই আসাদের প্যারামিলিটারি ইউনিটে যোগ দেওয়া শুরু করেছে।
কিন্তু এটা হবে এক কঠিন লড়াই। সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় তুরস্কের হাতকে সম্ভবত আরও শক্তিশালী করবে। মোটের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সিরিয়ার দ্বন্দ্বে অন্য প্রধান বিদেশি শক্তিগুলো তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরান নিজেদের প্রভাববলয় সংহত করতে সক্ষম হবে এবং যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের সুযোগ-সুবিধা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। তাদের সুনির্দিষ্ট আগ্রহের ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও এই তিনটি দেশ একটি ব্যাপারে একমত পোষণ করে আর তা হচ্ছে সিরিয়ার বিভক্তি, যা আসাদ ও বিদ্রোহীদের বিভিন্ন শক্তির পুতুলে পরিণত করবে।
এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইরান হবে দুই বড় বিজয়ী। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হচ্ছেন প্রধান অভিনেতা, যাঁর সময়োচিত সামরিক হস্তক্ষেপে আসাদের শাসনকে পরাজিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিকে তাঁর অনুকূলে নিয়েছেন। সিরিয়ার কোনো জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রকে দেখা না গেলেও রাশিয়া থাকবে সব জায়গায় এবং দ্বন্দ্বের দাবার বোর্ডের ঘুঁটিগুলোকে বিরতিহীনভাবে সাজাতে থাকবে।
রাশিয়ার মতো ইরানও আসাদের শাসনকে রক্ষা করার জন্য বহু রক্ত ও সম্পদ বিনিয়োগ করেছে। তবে বিনিময়ে অনেক পেয়েছে ইরান। সিরিয়ায় এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি হচ্ছে ইরান। যেমনটি তারা প্রভাবশালী ইরাক ও লেবাননে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া জায়গা দখল করতে যে দৌড় শুরু হবে, তা একটি অঞ্চলভিত্তিক যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। এমন একটি উদ্বেগও রয়েছে যে ইসরায়েল ইরান ও সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর ওপর হামলা আরও তীব্রতর করার জন্য মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করতে পারে। এ রকম হলে এ অঞ্চলে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়বে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ফাওয়াজ এ জের্জেস লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক