নির্ভয়ে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাক নারী

দিনটি ছিল বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উত্তরণ উদ্যাপনের প্রথম দিন। ফলে কার্যত অবরুদ্ধ ছিল ঢাকা মহানগরী। প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় অফিস থেকে ফেরার পথে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ অতিক্রম করার সময় চোখে পড়ে জনাকীর্ণ একটি বাস। বাসটিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। সংরক্ষিত নারী আসনের আশপাশে সর্বোচ্চ মাত্রায় শরীর সংকুচিত করে দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ-সাতটি মেয়ে। তাদের বয়স আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যে। জানি না তাদের গন্তব্য কোথায়। কিন্তু অজানা আশঙ্কায় কুঁকড়ে যাওয়া তরুণীদের দেহভঙ্গি ও মুখের অভিব্যক্তি দেশের অগ্রযাত্রার আত্মবিশ্বাসকে প্রতিফলিত করেনি।

সম্প্রতি ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক কিংবা অন্যান্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে ২০১৭ সালে অ্যাকশনএইডের উদ্যোগে বিশ্বের ১০টি শহরের ওপর পরিচালিত গবেষণায়ও দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ নারী গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। নারীর প্রতি যৌন হয়রানির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, হয়রানির শিকার ৫৭ শতাংশ নারী অপমানিত বোধ করেন, ৬৪ শতাংশ অসম্মানিত বোধ করেন, ৫৩ শতাংশ বিব্রত বোধ করেন এবং ৪৯ শতাংশ প্রচণ্ড ভয় পান পথ চলতে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন নারীদের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে স্থায়ী মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং এই অভিজ্ঞতা তাঁদের অনেককে জীবনভর তাড়া করে ফিরছে।

এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে প্রায় ২০ শতাংশ নারী গণপরিবহন ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন। চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন প্রায় ৮ শতাংশ নারী। পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল হিসেবে প্রায় ৪৬ শতাংশ নারী হিজাব ব্যবহার করছেন। নারীর প্রতি গণপরিবহনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিশ্চিতভাবেই জানান দেয় যে নারীর এ ধরনের কোনো কৌশলই তেমন কোনো কাজে আসছে না। এই যে নারী চলাচলের পথটি আজ শ্বাপদসংকুল, এর ফলাফলও দেখছি আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সম্প্রতি সিপিডির গবেষণায় জেনেছি, তৈরি পোশাকশিল্পে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আগে যেখানে এই শিল্পে ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক ছিলেন, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ শতাংশে। এর জন্য দায়ী মূলত অনিরাপদ গণপরিবহন ও নিরাপত্তাহীনতা। কয়েকটি তৈরি পোশাকশিল্প এলাকায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের অপর গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে প্রায় ১৪ শতাংশ নারী শ্রমিক কারখানার ভেতরে এবং ১৯ শতাংশ নারী শ্রমিক কারখানার বাইরে যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। এই নারীদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে আসছেন, তাঁদের অর্ধেকের বেশিই যদি রাস্তায় কিংবা গণপরিবহনে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাহলে তাঁরা সামনে এগিয়ে যাবেন কী করে! সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি কখনো ভেবে দেখেছে, নারীর প্রতিদিনের এই অনিরাপদ পথচলা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে কতখানি ব্যাহত করছে? পুনরুৎপাদনশীল কাজে নারীর অবদান আজও স্বীকৃত হয়নি। আর উৎপাদনশীল কাজে নারীর অংশগ্রহণকে যদি নিরাপদ করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নটি চিরকাল অধরাই রয়ে যাবে। আমরা জানি, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পোশাকশিল্পের অবদানের কথা, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ দিনে দিনে কমে গেলে অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় জেন্ডার সমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে নারীর চলার পথের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর পথচলা প্রায়ই থমকে যায় নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। রোজকার প্রতিবন্ধকতা পায়ে ঠেলে নারীর এগিয়ে যাওয়া তাঁর প্রচণ্ড ধৈর্য আর আত্মবিশ্বাসকে বারবার প্রমাণ করে। টিউশনি করতে গিয়ে সেনানিবাসের কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের ভেতরে তনুরা ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে কিংবা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় চাকরিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষিত হয়ে ঘাড় মটকানো অবস্থায় রূপারা নিথর দেহ পড়ে থাকে শালবনে। তারপরও সামনে এগিয়ে যায় হাজারো তনু কিংবা রূপা। অদিতি বৈরাগীর মতো অনেকে আজকাল প্রতিবাদও করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬-১৭ অর্থবছরের যে শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে যে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী অনেক এগিয়ে। মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষের কর্মসংস্থানের বিপরীতে নারীর কর্মসংস্থানের হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমবাজারেও নারীর প্রাধান্য দেখা যায়।

রাস্তাঘাটে ও গণপরিবহনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কয়েকটি বিষয়ে জোর দেওয়া খুব জরুরি। সর্বস্তরের জনসচেতনতা এবং জনগণকে সুসংগঠিত করতে জনসচেতনতা তৈরির জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। কিশোর ও তরুণ সমাজ, শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, পরিবহনমালিক ও শ্রমিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়বদ্ধতা ও সামর্থ্যের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। বিষয়টি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা ও সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। নারী একটি স্বাধীন সত্তা। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ও নিরাপদভাবে পথচলা তার রাষ্ট্রীয় অধিকার। এটি কারও দয়ার দান নয়।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]