ট্রাম্প জানান দিলেন তিনি আছেন

সিরিয়ায় আঘাত হানছে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: এএফপি
সিরিয়ায় আঘাত হানছে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: এএফপি

১৫ বছরের ব্যবধান, অথচ কী অদ্ভুত মিল। শুক্রবার সিরিয়ায় তিনটি কথিত রাসায়নিক মারণাস্ত্র স্থাপনা হাওয়াই হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট বার্তায় বলেন, ‘লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।’ ২০০৩ সালে, ঠিক এমনই এক বসন্তে, প্রশান্ত মহাসাগরে, জঙ্গিবিমানবাহী রণতরি ইউএসএস আব্রাহাম লিংকনের ডেকে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ বলেছিলেন ইরাকে ‘লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।’
১৫ বছরে যাদের স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়নি, তাদের মনে থাকবে, কার্যত অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তোলার বাইরে ইরাক আক্রমণ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা টেকসই কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ইরাকের কর্তৃত্ববাদী শাসক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত থাকার অভিযোগে পশ্চিমা শক্তিগুলো ওই যুদ্ধে জড়িয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের কাছে এখনো রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত রয়েছে এবং সেগুলো নিজের দেশের লোকদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে—এ অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হামলায় শরিক হয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর থেকে শতাধিক মিসাইল ছুড়ে একটি রাসায়নিক মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা, একটি ফাঁড়ি এবং একটি মজুত স্থাপনা নিশ্চিহ্ন করা হয়। রাশিয়া বা ইরান কেউই হামলা থামানোর বা এতে নাক গলানোর চেষ্টা করেনি। হামলার পরপরই ট্রাম্প সাফল্য অর্জনের দাবি করেন। ওদিকে সিরীয় বাহিনীর দাবি, ১০৩টির মধ্য ৭১টি মিসাইল তারা আটকে দিয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলো হামলার প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। তাদের আচরণে বোঝা যায়, সিরিয়াকে কথিত যুদ্ধাপরাধে তারা ছাড় দিতে রাজি নয়। তবে কেউই সমস্যা সমাধানের কোনো রাস্তা দেখায়নি। অন্যদিকে আরব গণমাধ্যমে হামলাকে ‘লক্ষ্যহীন’ বলা হয়েছে। আন্তআরব মুখপত্র ‘আল আরাবি আল-জাদিদ’-এ সিরীয় বিশ্লেষক আমর কুশ মন্তব্য করেন, ‘এই হাওয়াই হামলায় একটি অপরিহার্য বিষয়ের ঘাটতি রয়েছে: [আর সেটা হলো] একটি অনুবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচি।’ টিভি স্টেশন আল-জাজিরাও সামরিক অভিযানের স্থায়ী প্রভাব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে।
এটা ঠিক, সীমিত সামরিক হামলা বাশার আল-আসাদের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা কিছুটা কমেছে। কিন্তু সিরিয়ার সব মজুত ধ্বংস হয়নি। এই হামলার আগের ছয় দিন গেল দুই পক্ষের মধ্যে গরম বাক্য চালাচালিতে। এই ফাঁকে সিরিয়া অস্ত্র লুকিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়। পেন্টাগনের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ কেনেথ ম্যাককেনজির কথায় এমন ইঙ্গিত রয়েছে। ‘আমরা যা ধ্বংস করেছি, কর্মসূচিটি তার চেয়ে বড়,’ তিনি বলেছেন। ‘আমরা অন্য জায়গায় যেতে পারতাম এবং অন্য কাজগুলো করতে পারতাম।’
শুক্রবারের হামলায় বাশার আল-আসাদের বড় ক্ষতি হয়েছে এ কথা বলা যাচ্ছে না। বরং উল্টোটাই ঘটেছে। তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত হামলায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি এবং সম্ভবত নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি ও প্রয়োগে সিরিয়ার ক্ষমতাও শেষ করেনি—এটা বোঝার পর দামাস্কাসে জনতা রাস্তায় নেমে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে ও জাতীয় পতাকা নেড়ে আনন্দোল্লাস প্রকাশ করে।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ট্রাম্পের মনোভাব পরিষ্কার নয়। মার্কিন গণমাধ্যম প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর বরাতে বলছে প্রেসিডেন্ট নিজেই নিশ্চিত নন তিনি কী করবেন। তিনি দোটানায় ভুগছেন। তাঁর মন্ত্রণাদাতাদের মধ্যে যাঁরা রোনাল্ড রিগানপন্থী, ‘দুর্বিনীত’কে শায়েস্তা করা যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মনে করেন, তাঁরা ট্রাম্পকে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁকে ঠেলে দিতে চাইছেন। অন্যদিকে সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন ও কেন্টাকির উদারবাদী সিনেটর র‍্যান্ড পলের মতো যাঁরা ‘একলা চলো’নীতিতে বিশ্বাসী, তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার পক্ষপাতী। ট্রাম্প গত নির্বাচনে ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সবার আগে’ স্লোগান দিয়ে বিজয়ী হন।
মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায়ই একমাত্র সমস্যা নয়। আইএস পর্যুদস্ত হয়েছে কিন্তু খতম হয়নি। মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, সন্ত্রাসী দলটি এখনো চোরাগোপ্তা হামলার ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে ইসরায়েল উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে সিরিয়ায় একটু একটু করে গেড়ে বসছে ইরান। এ কাজে তাকে সাহায্য করছে তার সামরিক মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহ। প্রেসিডেন্ট আসাদের সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে তারা। এদের সঙ্গে রাশিয়ার সেনাও রয়েছে। ইসরায়েল স্বভাবতই চায়, তেহরানের রাশ টেনে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় থাকুক।
বলতে কী, হোমসের পশ্চিমে দুটি ও দামাস্কাসের একটি জায়গায় পশ্চিমা হামলা এমন একসময়ে হলো, যখন বাশার আল-আসাদ সাত বছরের গৃহযুদ্ধ জিততে চলেছেন। দোমা শহরে গ্যাস ব্যবহারের কারণে এটি তেমন প্রচার পায়নি। ৮ এপ্রিল বিদ্রোহীদের শেষ শক্ত ঘাঁটিটি আসাদ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সপ্তাহজুড়ে জৈশ আল-ইসলামের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের বাসে করে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে তুরস্ক। এটি যুদ্ধে আল-আসাদের সবচেয়ে বড় জয় মনে করা হচ্ছে; যা এমনকি ২০১৬-তে পূর্ব আলেপ্পো পুনর্দখলের গুরুত্বকেও ছাপিয়ে গেছে। এতে তাঁর মিত্র রাশিয়া ও তুরস্ক।

এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্য একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে এমনটি মনে করা হয়তো বেশি হবে না যে আল-আসাদকে শায়েস্তা করার জন্য সীমিত পরিসরে আক্রমণের ছলে ওয়াশিংটন, লন্ডন ও প্যারিস আসলে ‘মৃদুভাবে’ জানান দিল, এ অঞ্চলে যেকোনো রদবদলে তারাও স্টেইকহোল্ডার।

রওশন জামিল চৌধুরী: সাংবাদিক
[email protected]