সুন্দরবনে কয়লার অত্যাচার আর যুক্তরাষ্ট্রের বিচার

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের এখনো একটা সুন্দরবন আছে, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে নেই। বাংলাদেশে সুন্দরবনের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে কয়লার বিষ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস শহরের মাটি-পানি-বাতাসকে হুমকিতে ফেলা গ্যাস কোম্পানিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ১৩ জনকে আদালত দিয়েছেন নিঃশর্ত মুক্তির রায়। কয়লার থাবা থেকে সুন্দরবনকে বাঁচানোর দাবি নিয়ে বের হওয়া মিছিলে বিগত বছরগুলোয় নির্বিচারে চলেছে লাঠি-গুলি-কাদানেঁ গ্যাস। বাঁশখালীতে হত্যা করা হয়েছে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী চার প্রতিবাদকারীকে। অন্যদিকে, কয়েক হাজার মাইল দূরে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া প্রতিবাদকারীদের পক্ষ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন সে দেশের আদালত।

২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট রক্সবারিতে ‘ফ্রাকড গ্যাস’ সঞ্চালন পাইপলাইন তৈরির কাজ করছিল ‘স্পেকট্রা এনার্জি’ নামের একটি কোম্পানি। কিন্তু এই গ্যাস উত্তোলনপ্রক্রিয়ায় পানির স্তর দূষিত হয় আর বাতাসে ছড়ায় বিষাক্ত গ্যাস। তাই মাটি-পানি আর বাতাসের বিশুদ্ধতার দাবি নিয়ে প্রতিবাদকারীরা বন্ধ করে দেয় ওই পাইপলাইন নির্মাণকাজ। অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে প্রতিবাদকারীদের। অবশেষে গত মাসের ২৭ তারিখ বিচারক তাঁর রায়ে জানিয়ে দেন যে পরিবেশ রক্ষার দাবিতে প্রতিবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর কোনো অপরাধ নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে খুন, জুলুম, অত্যাচারের বিচার এখনো বাকি। সিডর-আইলার তাণ্ডব থেকে উপকূল বাঁচানো সুন্দরবনও কয়লাবিদ্যুৎসহ অজস্র পরিবেশবিরোধী প্রকল্পে জেরবার।

সুন্দরবনের বুক চিরে তৈরি করা বাণিজ্যিক নৌ-রুটে ২০১৪ সালের দুর্ঘটনায় ছড়িয়েছে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেল, ২০১৫ সালে ডুবেছে ৫০০ টন সার, ২০১৬ সালে ডুবেছে ১ হাজার ২০০ টন কয়লা, ২০১৭ সালে ডুবেছে ১ হাজার টন কয়লা। ওই এলাকায় যেন দুর্ঘটনার মচ্ছব লেগেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর অনুসন্ধানী কমিটি হয়েছে, বিদেশ থেকেও এসেছে তদন্তকারী দল। কিন্তু সুপারিশগুলো বন্দী থেকেছে ছাপার অক্ষরেই। অবহেলাকারীদের বিচার হয়নি, বরং বিচার চাওয়া মিছিলে হামলা হয়েছে। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ হয়নি, বরং এই কয়লার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা প্রতিবাদকারীরা লাঠিপেটা আর কাঁদানে গাসের শেলে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। ক্ষমতার চোখরাঙানি, হুমকি-ধমকি সবই বরাদ্দ কেবল পরিবেশের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে চাওয়া মানুষগুলোর জন্য। অন্যদিকে, সুন্দরবনের ওপর হামলে পড়াদের জন্য বরাদ্দ আছে বিচার না হওয়ার দায়মুক্তি আইন। ফলে গতকালও সুন্দরবনের ভেতরে মোংলা সমুদ্রবন্দরের পশুর চ্যানেলে ডুবে গেছে ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লাবোঝাই লাইটার জাহাজ

অজস্র প্রাণ ধারণ করা সুন্দরবন এক জীবন্ত সত্তা। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসতে থাকা এ বন এখনো কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজন মেটাচ্ছে, কিন্তু এর বেঁচে থাকতে চাওয়ার তীব্র আকুতি আমাদের কানে ঢুকছে না। সুন্দরবন মরার কালে আমাদের চোখের সামনে তড়পাবে না, এর প্রাণ সবার অগোচরেই উবে যাচ্ছে, যাবে। সেখানে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমছে। মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে বাঘের সংখ্যা ৪৪০ থেকে নেমে এসেছে ১০৬টিতে। (ডেইলি স্টার, ২৯ জুলাই, ২০১৭)। শুধু কি কয়লা! উজানে ফারাক্কা বাঁধে পানি প্রত্যাহারের ফলে সুন্দরবনে লোনা পানির আগ্রাসন বাড়ছে। এই বনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বাঁধ, পোল্ডার। পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সুন্দরবনের আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে গড়ে ওঠা ১৯০টি দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখনো বহাল তবিয়তে ।

জল-জমি-জঙ্গল দখল আর দূষণের প্রতিযোগিতা শুধু প্রান্তে নয়, কেন্দ্রেও ছড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি এখন আলকাতরার মতো কালো, যমুনার বড় অংশই এখন খাল। আর অসংখ্য খাল পরিণত হয়েছে ড্রেনে। ওয়াসার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর ৪৩টি খালের মধ্যে ১৭টির কোনো অস্তিত্বই এখন আর অবশিষ্ট নেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন খাবার পানি জোগানের দায়িত্ব চেপেছে কোম্পানিগুলোর কাঁধে। দেড় লিটার বোতলের ‘বিশুদ্ধ’ পানির দাম এখন ২৫ টাকা আর মাঝারি আকারের এক ট্যাংক সাপ্লাই পানির দাম ঘুষসহ ৫০০ টাকা!

উন্নয়নের টালিখাতায় সুন্দরবনের অস্তিত্ব না থাকলেও প্রবৃদ্ধির হিসাব মিলবে। বনের জমি দখল করে শিল্পকারখানা হলে, নদীগুলো দখল করে আলিশান দালান বানালে, বাতাসে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়ানো কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুললে জিডিপির ঘোড়া বরং লাফিয়ে লাফিয়েই আগে বাড়বে। কিন্তু এরই মাঝে খরচ হতে থাকবে আমাদের জীবন, খরচ হবে নদী, প্রাণ, প্রকৃতি, খরচ হবে সুন্দরবন। উপকূলের কয়েক কোটি মানুষ হয়ে পড়বেন সামুদ্রিক দুর্যোগ ও ঝড়ের সামনে অসহায়। কাজেই উন্নয়নকে সংখ্যা দিয়ে মাপার দর্শনকে প্রশ্ন জানাতে হবে।

মওদুদ রহমান: প্রকৌশলী ও গবেষক।
[email protected]