আমরা কি সুখবর ভালোবাসি না?

পত্রিকা খুললেই দুঃসংবাদ। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি তো আছেই; খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ও দুর্নীতির খবরও পাতায় পাতায়। জঙ্গিদের উত্থান নিয়েও এন্তার খবর। আচ্ছা, দেশে কি ভালো খবর কিছু নেই? কোথাও কোনো সুখবর খুঁজে পাই না কেন! দেখেশুনে মনে হয়, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো বেছে বেছে বুক কেঁপে ওঠে, মন খারাপ হয়, এমন খবর ছাপতেই অধিক আগ্রহী। সম্পাদক বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, সবার একই যুক্তি, মন্দ খবর চলে ভালো, পাঠক তেমন খবর পড়তেই ভালোবাসে।

কথাটা হয়তো একদম মিথ্যা নয়। নোবেল বিজয়ী ইসরায়েলি মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কানম্যান জানান, আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ভালো-মন্দ নানা খবর প্রক্রিয়াজাত করে। ‘আমিগডালা’ নামে মস্তিষ্কের একটি অংশ বিপদের সংকেত দেয়। এই আমিগডালার কারণেই আমাদের আদি পুরুষেরা প্রকৃতির হাজারটা বিপদের সংকেত আগেভাগে পেয়ে আত্মরক্ষার পথ খুঁজে নিতেন।

কোনো ঝোপে সামান্য শব্দ হলে তাঁরা এই আমিগডালার বদৌলতে বুঝে যেতেন ওই ঝোপে সাপ বা বাঘ লুকিয়ে আছে, অতএব পালাও। আধুনিক মানুষ বাঘ-সাপের বিপদ এড়ানোর ভিন্ন পথ পেয়ে গেছে, কিন্তু বিপদ নিয়ে তার উদ্বেগ যায়নি। আমিগডালার কারণে সে এখনো মন্দ খবরের ব্যাপারেই কান খাড়া করে থাকে।

আমি মনোবিজ্ঞানী নই, মনোবিজ্ঞানে আস্থাও নেই। মানুষ মন্দ খবরে বেশি আগ্রহী, এমন কথায় বিশ্বাস স্থাপনে আমার মন সায় দেয় না। বরং এ কথায় আমার বিশ্বাস আছে, ভালো খবর পাঠকের কাছে গুরুত্বের সঙ্গে পৌঁছে দিলে সে অবশ্যই আগ্রহ নিয়ে সে খবর পড়বে। এ কথা প্রমাণের জন্য আপনাকে নোবেল বিজয়ী হতে হবে না, স্রেফ মাঝেমধ্যে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ বোলালেই হবে।

সেখানে মন্দ খবর নেই তা নয়, কিন্তু যে খবর প্রায় ক্ষেত্রেই পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়, তা নির্ঘাত ইতিবাচক। নেতিবাচক খবরের পাশে ইতিবাচক খবর কত বেশি ‘শেয়ার’ হয়, সে হিসাবটা নিলেই এই সত্যটি ধরা পড়বে বলে আমার অনুমান।

একটা উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে ফেসবুকেই আমি দিনাজপুরের এক চিকিৎসকের কাহিনি পড়েছিলাম। মনে নেই, সম্ভবত প্রথম আলো থেকেই খবরটা নেওয়া। ভদ্রলোকের নাম বসন্ত কুমার রায়। অর্ধশতক আগের কথা, চিকিৎসক হওয়ার পর ঢাকা বা বড় কোনো শহরে চাকরি গ্রহণের বদলে তিনি নিজ জেলা শহরে ফিরে এসে নামমাত্র দর্শনীতে চিকিৎসা শুরু করেন।

নামমাত্র মানে এক টাকা। একটানা ৫০ বছর বসন্ত রায় তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, এত দিনে তাঁর ভিজিট বেড়ে হয়েছে ৪০ টাকা। মানুষের
সেবা হবে, এই উদ্দেশ্যে নিজের ভাইকেও তিনি চিকিৎসক বানিয়েছেন। বেশ বড় প্রতিবেদন, পড়ে মনটা ভরে গিয়েছিল। লক্ষ করেছিলাম, কত অসংখ্য লোক তাতে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিল, তাতে ‘লাইক’ দিয়েছিল।

মোটেই অস্বাভাবিক গল্প নয়, আমাদের দেশে হয়তো এমন আরও অনেক বসন্ত রায় রয়েছেন। তাঁদের কাহিনি ছাপা হলে পাঠক ‘নেবে না’, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমাদের তো বোতলে দুধ খাওয়ানোর মতো খবরওয়ালারা কেবল মন্দ খবরই ভজাচ্ছেন, তাহলে অন্য খবর ‘নেওয়ার’ সুযোগ কোথায়?

পাঠক সুখবর পেতে চায়, এ কথাটা অন্য কোথায় কী হয় জানি না, কিন্তু আমেরিকায় পত্রিকার সম্পাদকেরা এখন পরিকল্পিতভাবে পাঠকের কাছে সুসংবাদ তুলে দেওয়া শুরু করেছেন। যেমন নিউইয়র্ক টাইমস আলাদা করে ‘দিস উইক ইন গুড নিউজ’ নামে নিয়মিত একটি কলাম চালু করেছে। পত্রিকায় সারা সপ্তাহে কমবেশি যেসব সুখবর ছাপা হয়, এই কলামে তার গোটা কয়েক বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাছাই করে ছাপানো হয়। উদ্দেশ্য, এই খবর পড়ে পাঠকের যেন মনে হয় মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয়নি, মানুষ এখনো মানুষকে ভালোবাসে, কোনো স্বার্থভাবনা ছাড়াই কেউ কেউ এখনো অসহায় বা অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
আলাদা করে ‘গুড নিউজ’ দেওয়ার কী কারণ, তার ব্যাখ্যায় পত্রিকার সম্পাদক লিখেছেন, আমরা প্রতিদিন মন্দ খবরের ভারে নুইয়ে আছি। কিন্তু
সব খবরই যে মন্দ তা নয়। এই কলামের উদ্দেশ্য পাঠক যেন সপ্তাহান্তে মুখজুড়ে হাসি, বুকে আশা নিয়ে যেতে পারেন। ৫ এপ্রিলের ‘গুড নিউজ’ কলামে যে সাত-আটটা খবর সংকলিত হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমটাই মন ভালো করে দেয়। খবরটা এই রকম।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা তাঁদের অভাবের কথা জানিয়ে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। কারও হয়তো কালি-কলমের অভাব, কারও বিজ্ঞান ক্লাসের যন্ত্রপাতি নেই, কারও লাইব্রেরিতে বই কেনার অর্থ নেই, কারও-বা কম্পিউটারের অভাব রয়েছে। ব্রঙ্কসের এক স্কুলশিক্ষক তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইটে এসব অনুরোধ তুলে ধরতেন। সে কথা জানতে পেরে রিপল নামের একটি কোম্পানি একাই ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার চাঁদা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই অর্থে তালিকাভুক্ত প্রতিটি অনুরোধ তো রক্ষা হলোই, আরও অনেকের কাছে সাহায্য পাঠানোও সম্ভব হলো।

আরেক ‘গুড নিউজে’ জানানো হয়েছে, ইনফ্রারেড বা অবলোহিত ক্যামেরা ও প্রযুক্তির সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ধ্বংসের মুখোমুখি প্রজাতির প্রাণী রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। প্রথম যারা এই প্রযুক্তির সুফল পাচ্ছে, তারা হলো মালয়েশিয়ার একজাতীয় খরগোশ।

এই কলামে এক ভিডিও সংবাদে রয়েছে জাপানের তুষার বানরের গল্প, এরা ঠান্ডা কাটানোর জন্য উষ্ণ ঝরনায় দল বেঁধে এসে স্নান করছে। একই কলামে একটি ‘ফটো স্টোরি’ রয়েছে, যেখানে জাপানের বিখ্যাত চেরি ব্লসমের কথা বলা হয়েছে। ধবধবে সাদা সে ফুলের অরণ্য দেখে মনটা কেমন অজানা আনন্দে ভরে ওঠে।

একা নিউইয়র্ক টাইমস নয়, আরও সংবাদ প্রতিষ্ঠানই পাঠক-দর্শকদের জন্য আলাদা করে নির্বাচিত সুখবর পৌঁছে দিচ্ছে। মাইক্রোসফট তার ওয়েব পাঠকদের জন্য একটি সুন্দর নিউজ সাইট করেছে। সেখানে রাজনীতি, বিনোদন, ক্রীড়া ইত্যাদির পাশাপাশি একটি নিয়মিত কলাম রেখেছে, যার নাম, হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, ‘গুড নিউজ’। এই কলাম লিখতে লিখতেই সেখানে পড়লাম মিলুওয়াকির এক মায়ের গল্প।

কয়েক বছর আগে লেসলি মরিসেট নামের এক তরুণী মায়ের শিশুপুত্র ক্যানসারে মারা যায়। নিজের পুত্রের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে লেসলি ক্যানসারে আক্রান্ত অন্য শিশুদের, বিশেষত যারা অভাবী, তাদের জন্য ল্যাপটপ বা আইপ্যাডের মতো ইলেকট্রনিক উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০-এর বেশি শিশুকে তিনি এভাবে সাহায্য করেছেন। কাজটা তিনি একা শুরু করেছিলেন, কিন্তু এখন অনেকেই তাঁর পাশে।

শুধু পত্রিকায় নয়, অনেক টিভি চ্যানেলেও দেখছি আলাদা করে সুখবরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অস্বাভাবিক, অভাবিত কোনো খবর নয়, সাদামাটা মানুষের খবর, যেমন লেসলি মরিসেটের মতো মায়ের খবর, যা পড়ে মনে হয় চাইলে আমরা যে কেউই এমন ‘নায়ক’ হতে পারি।

বিদেশি পত্রিকার সুখবর নিয়ে এই সাতকাহনের একটাই উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের পত্রিকার সম্পাদক ও টিভির প্রযোজকদের কাছে অনুরোধ রাখা, তাঁরাও যেন এ ধরনের সুখবর পাঠক ও দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন হন। বলছি না তাঁরা সুখবর দেন না, কিন্তু সব সময় সে খবর পরিবেশনার পেছনে যত্ন ও পরিকল্পনা রয়েছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক কোন্দল ব্যাখ্যা করতে যে সময়, শ্রম ও পত্রিকার পাতা তাঁরা ব্যয় করেন, তার শত ভাগের এক ভাগও যদি সুখবর দিতে ব্যয় হয়, তাহলে তাঁরা পাঠকের কৃতজ্ঞভাজন হবেন, এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই।

হাসান ফেরদৌস : যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি