ইতিহাসের এক অনন্য দিন

ভাষণ দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম
ভাষণ দিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসে অপূর্ব একটি ঘটনা ঘটে যায়। মেহেরপুরের সীমান্তঘেঁষা প্রত্যন্ত এলাকার একটি গ্রাম ভবেরপাড়া। এই গ্রামে খানিকটা এলাকাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বৈদ্যনাথতলা আমবাগান। কে জানত এই আমবাগান সাক্ষী হয়ে থাকবে ইতিহাসের!

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আইনানুগভাবে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই আমবাগানের একপাশে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু করে তাদের কঠিন ও মহত্তম কর্মযজ্ঞ। এখানে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদের আরও তিনজন সদস্য-এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। (খোন্দকার মোশতাক, যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পক্ষে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এ কারণে একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যাতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে, সে জন্য তাঁকে দায়িত্ব পালনে বিরত রাখা হয়। তাঁর পরিবর্তে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিদেশে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনায় খোন্দকার মোশতাকের ভূমিকা ছিল মুখ্য। আমি আজ এ বিষয়টির উল্লেখ করলাম এ জন্য যে ভবিষ্যৎ গবেষকদের খুঁজে বের করতে হবে আমাদের দুর্বলতা, আমাদের ঘাটতি। যেন দেশকে বারবার কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়।)

১৭ এপ্রিল ভোরবেলা ছিল বৃষ্টিতে ভেজা। প্রকৃতি যেন একপশলা বৃষ্টিতে ধুয়ে দিয়ে যায় নতুন বাংলাদেশকে। হাজারো এলাকাবাসী এবং দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক প্রত্যক্ষ করেন সেই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। ভাষণ দেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্মলাভের যৌক্তিক ও অনিবার্য চিত্র তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে। প্রথমেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিক বন্ধুদের ধন্যবাদ জানান এ জন্য যে তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলার মাটি দেখে যাওয়ার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূরদূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। এরপর তিনি মূল বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।’

মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত, পূর্বাপর সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন তাজউদ্দীন আহমদ। ভাষণের একপর্যায়ে বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য।...প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রটিকে লালিত-পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না।’

ভাষণ শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তাজউদ্দীন আহমদ। এক বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ থেকে এই এলাকার নাম ‘মুজিবনগর’।

মুজিবনগরের আম্রকাননে শপথ গ্রহণকারী এই সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয় সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ। এই সরকারকে বিদেশের মাটিতে বসে দেশের আত্মসম্মান সমুন্নত রেখে বিশ্ব কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক আবহকে প্রতিমুহূর্তের বিশ্লেষণ ও বিবেচনায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সংগঠিত করতে হয় মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত বিষয়কে, একই সঙ্গে আশ্রয়হীন সহায়-সম্বল ফেলে আসা লাখ লাখ মানুষ, যা একপর্যায়ে কোটির ঘরে পৌঁছে যায়, তাদেরও পরম মমতায় সীমিত সামর্থ্যে আগলে রাখে এই সরকারই। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্র, রসদ, টাকাপয়সার সংস্থান-সবই করতে হয় সরকারকে। মোকাবিলা করতে হয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানামুখী ষড়যন্ত্র। এসব কর্মযজ্ঞ পালনের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। মাতৃভূমির ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করেন বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর (তৎকালীন) আনসারসহ সকল পর্যায়ের মানুষ। বুদ্ধিজীবী চিন্তাশীল ব্যক্তিরাও এই প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড় কে না ছিলেন! সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে যে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার লড়াই, তার প্রাণ ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, একটি আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা আছে একখণ্ড কাপড়, যেখানে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা-স্বাগতম Welcome এবং জয় বাংলা Joy Bangla। মনে প্রশ্ন ছিল, সেদিন সেই অজপাড়াগাঁয়ে কীভাবে এল এটি? ১২ বছর আগে জানতে পারি, সেদিন সেই ভবেরপাড়ার ‘সেন্ট বারথলোনিয়া কাপিতানিও অরফানেজ’ মিশনের সিস্টার ক্যাথরিন গনজালভেস লাল কাপড়, তুলা, তরল আঠা আর বোতাম দিয়ে তৈরি করেছিলেন এটি স্থানীয় ছেলেদের অনুরোধে।

আরও ভালো লাগে, সেদিনের অনুষ্ঠানে কাঠের চেয়ারগুলো দিয়েছিলেন সেই মিশনের ফাদার ফ্রান্সিস। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয়, তারই যেন অতুলনীয় নিদর্শন ছিল সেদিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ন্যায়ের সংগ্রামে ভারত সরকার ও জনগণ যেভাবে দুর্দিনে প্রকৃত বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তা-ও স্মরণীয়।

সিমিন হোসেন রিমি: সংসদ সদস্য, লেখক ও সমাজকর্মী
[email protected]