সুদের হার কমান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও ব্যাংক সুদের হার কমানোর তাগিদ দিলেন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের। গত শুক্রবার বাংলা নববর্ষের আগের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) কাছ থেকে অনুদান নেওয়ার সময় তিনি এ তাগিদ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের সুদের হার কমানোর কথা বলতে চাই, না হলে দেশে বিনিয়োগ সম্ভব নয়। এটিকে অবশ্যই সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে।’ তবে তিনি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে কথাটি বলেছেন, তা হলো ‘আমরা আপনাদের উত্থাপিত সব সমস্যার সমাধান করেছি, এখন আপনাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকারদের কী কী সমস্যার সমাধান করেছেন, তা স্পষ্ট না করলেও আমরা জানি যে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে চাপ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ও সংখ্যা দুটোই বাড়িয়ে নেওয়া। আগে পরিচালকেরা একনাগাড়ে সর্বোচ্চ ছয় বছর পদে বহাল থাকতে পারতেন। এখন সেটি নয় বছর করা হয়েছে। আগে একই পরিবার থেকে দুজন সদস্য পরিচালক থাকতে পারতেন, সেটিও বাড়িয়ে চারজন করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে এমন নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে সরকারি তহবিলের ৫০ শতাংশ অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যাবে। এত দিন এটা ছিল ২৫ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার পূরণ করার জন্য ব্যাংক মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তা করবেন কি না, করলেও কবে করবেন, সেসব এখনো অজানা। প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবার তাগিদ সত্ত্বেও ব্যাংক মালিকদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বরং বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান গণমাধ্যমের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন। এর আগে তাঁরা গণমাধ্যম যাতে ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে না লেখে, সে ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপও চেয়েছিলেন। এসব বক্তব্যে যেমন নিজেদের ব্যর্থতা লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা আছে, তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপও বটে। আমরা ব্যাংক মালিকদের এ ধরনের মানসিকতার নিন্দা করি। বিএবির চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে দোষারোপ না করে যদি যেসব ব্যাংক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে, তাদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তেন, তাহলে ব্যাংক খাত বিপর্যয় থেকে রেহাই পেত।
এর আগেও ব্যাংক মালিকেরা সরকারের চাপে ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছিলেন। পরে নানা অজুহাতে আবার বাড়িয়েছেন। ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো সম্ভব নয়। প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিনিয়োগে যে মন্দা চলছে, তার অন্যতম কারণ ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি। ব্যাংক মালিকেরা ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধির জন্য সঞ্চয়পত্রের উচ্চসুদের হারকে যে দায়ী করেছেন, সেটিও পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়। জাতীয় সঞ্চয়ের সামান্য অংশই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়। কিন্তু তাঁরা যে সত্যটি আড়াল করেন তা হলো ব্যাংকে আমানত নেওয়া ও ঋণ দেওয়ার মধ্যে সুদের হারের ফারাক অনেক বেশি। অন্যান্য দেশে এ দুইয়ের ব্যবধান ৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত, কিন্তু বাংলাদেশে ৫ শতাংশেরও বেশি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, সুদের হার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে কমবে। কিন্তু তিন বা ছয় মাস লাগবে কেন? ব্যাংক মালিকেরা যে সুবিধা নেওয়ার তা তো আগেই নিয়েছেন। এখন তাঁদের অঙ্গীকার পূরণের পালা। আশা করি, তাঁরা দেশের প্রধান নির্বাহীর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করবেন না। কবে সুদের হার কমবে, কত কমবে—ব্যাংক মালিকদের কাছ থেকে এখনই সুস্পষ্ট ঘোষণা চাই।