লাইসেন্স নীতিমালা ও জননিরাপত্তা

দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নবায়নের রুটিন কাজটি সম্প্রতি শেষ হলো। লাইসেন্স ফি এক লাফে কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়াসহ গুলি ক্রয় বা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধানসহ ‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬’ হলেও এ নিয়ে কেউ সরব হননি। অন্যান্য জনবিচ্ছিন্ন আইনের মতোই এই নীতিমালার বিষয়ে ক্ষোভ থাকলেও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এর কারণ মূলত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সধারীরা বিবৃতি, বিক্ষোভ বা মানববন্ধন কর্মসূচি দেওয়ার মতো পর্যায়ে নেই।

ব্রিটিশ শাসন আমলে প্রবর্তিত আইন অনুসারে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদানের উদ্দেশ্য আত্মরক্ষা, জানমালের নিরাপত্তা এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যবহার। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে অস্ত্র চালনায় দক্ষতা থেকে শুরু করে অস্ত্র রাখা বা সংরক্ষণের সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনার পাশাপাশি লাইসেন্সধারীর নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা হয়। বস্তুত, ব্যক্তি বা জনগণের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে জনগণের বা ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানকল্পে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিধিবিধান প্রণয়ন বা জারির ক্ষেত্রে মনে হয় যে লাইসেন্সধারীরা যেন প্রশাসনব্যবস্থার প্রতিপক্ষ। লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বিধিবিধান প্রণয়ন ও জারির বেলায় অসংগতি বা বিধিবিধানের কার্যকারিতা বা জনস্বার্থ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দেশের আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্সধারীদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার তৈরির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান তথ্যভান্ডারের ঘাটতির কথা প্রকাশ পায়।

২.
গুলি ক্রয় বা সংগ্রহের ক্ষেত্রে ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিষয়ে ধরে নিই তাঁর মাধ্যমে গোলাবারুদ সংগ্রহ করলে হিসাবটি তাঁর কাছে থাকল। কিন্তু গুলি সংগ্রহের বাৎসরিক পরিমাণ লাইসেন্সেই নির্ধারিত থাকে। সেই সঙ্গে গুলি কেনার সময় তার পরিমাণও সেই লাইসেন্সে লিপিবদ্ধ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এই বাড়তি হয়রানি কেন? অপ্রয়োজনে কেউ বহু মূল্যবান গুলি নষ্ট করবেন না নিশ্চয়ই। বিশ বছর আগের সংগৃহীত গুলি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আরেকটি অদ্ভুত নিয়ম দেশে প্রচলিত আছে: যেকোনো নির্বাচনের আগে বা নির্বাচন চলার সময়ে, অর্থাৎ ভোটাভুটির সময়টিতে আগ্নেয়াস্ত্র স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জমা রাখতে হয়। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় যখন ব্যক্তির জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তখনই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে তাঁর কাছ থেকে তাঁর নিরাপত্তার জন্য রাখা অস্ত্রটি নিয়ে নেওয়া হলো। তাহলে সেই অস্ত্র রাখার আর কী মানে থাকল? বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বা দলীয় আনুগত্যের কারণে বা বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম ঘটিয়ে লাইসেন্স ইস্যুর ঘটনা ঘটেছে, সে ক্ষেত্রে প্রকৃত ও যোগ্য ব্যক্তিদের লাইসেন্স পুনর্নিরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে, সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও প্রকৃত এবং যাঁদের আসলেই প্রয়োজন তাঁদের লাইসেন্স বহাল রাখা যায়।

অতীতে পরিমাণে অনেক কম থাকলেও এই নীতিমালায় ক্ষুদ্র অস্ত্রের বেলায় পরপর তিন বছর তিন লাখ টাকা করে কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এখানেও ‘শুভংকরের ফাঁকি’ আছে। অর্থাৎ, আপনি একজন নাগরিক হিসেবে যদি ৩০ বছর ধরে পৌনে তিন লাখ টাকা করে আয়কর দিয়ে যান এবং আপনার যদি লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়, তাতেও কিন্তু আপনি লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য নন। অন্যদিকে কেউ যদি শুধু তিন বছর তিন লাখ টাকা করে আয়কর দেন, তাতেও তিনি যোগ্যতা অর্জন করলেন। তার মানে দাঁড়াল, আপনার সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থান যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক বা আপনার জীবনের ঝুঁকি থাকুক না কেন, আপনি লাইসেন্স পাবেন না। নীতিমালায় ‘প্রাধিকারভুক্ত’ বলে একটা বিষয় রাখা হয়েছে, যেটির আরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তাবেষ্টনী বা পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছায়া বা নাগালের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ভাবনার অবকাশ আছে। ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত ব্যক্তি’ বলে যে শব্দগুলো রাখা হয়েছে, নীতিমালায় তারও কোনো সংজ্ঞা নেই।

কখনো কখনো রাজনৈতিক মারামারি বা হানাহানিতে লাইসেন্স করা অস্ত্রের অপব্যবহার হয়েছে বলে অভিযোগ গণমাধ্যমে দেখা যায়। সেই অস্ত্রগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রভাব বা দলীয় বিবেচনায় লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এ ছাড়া লাইসেন্সধারীদের দ্বারা কোনো অবৈধ কাজ বা অপরাধ ঘটানোর কথা শোনা যায় না। কারণ, লাইসেন্সধারীরা দেশের আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই নিয়মনীতি বা বিধিবিধান মেনে লাইসেন্স করেছেন। অথচ এ বিষয়ে ধারণার ওপর ভিত্তি করে লাইসেন্সধারীদের প্রতি ঢালাও বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করা হয়। নিজেই নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে গেলেও অনেক ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা, কী আজব!

৩.
দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী খাসি জাতি দূর অতীতে তাদের নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরি করত এবং তারা এসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। খাসি গ্রাম বা পুঞ্জির প্রতিবেশী চা-বাগানের বাংলোগুলোতে প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটে; কিন্তু পুঞ্জিগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বিরল। এর কারণ হলো তাদের কাছে আত্মরক্ষা এবং জানমাল রক্ষার জন্য লাইসেন্স করা অস্ত্র থাকে। বন পাহারা এবং মূল্যবান বনজ সম্পদ ও গাছ রক্ষার কাজেও লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের ব্যবহার হয়। সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলের নাহার পুঞ্জিতে উন্মত্ত, লেলিয়ে দেওয়া একদল আক্রমণকারীকে থামাতে পুঞ্জির লাইসেন্সকৃত বন্দুক থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হয়েছিল। এই ফাঁকা গুলি সেদিন নারী, শিশুসহ বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয়। দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী হিসেবে আয়করের ক্ষেত্রে রেয়াত থাকার ফলে বেঁধে দেওয়া আয়কর সীমায় পৌঁছা সম্ভব হয় না খাসিদের পক্ষে। ‘ওয়ারিশ’ সূত্রে লাইসেন্সপ্রাপ্তির ধারা বা বিষয়টিও তাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও পারিবারিক উত্তরাধিকার ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

রূঢ় বাস্তবতা হলো, অভিজ্ঞ আইনপ্রণেতাদের দিয়ে এসব নীতিমালা প্রণয়ন বা সংশোধন করানো হয় না। ফলে ত্রুটি থেকেই যায়। জনসম্পৃক্ততাবিহীন লোকজনের দ্বারা প্রণীত নীতিমালা বস্তুত সরকার বা নীতিনির্ধারকদেরই জনবিচ্ছিন্ন করে। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। শুধু আয়করের ভিত্তিতে না হয়ে প্রকৃত নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

পিডিশন প্রধান সভাপতি, বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরাম