টাকা যায় কোথায়?

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চতর প্রবৃদ্ধি রেকর্ড গড়লেও আমাদের আর্থিক খাত তথা সামগ্রিক অর্থনীতি যে সঠিক ধারায় চলছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বরং বিভিন্ন জরিপে আর্থিক খাত নিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসছে, তা দুশ্চিন্তার উদ্রেগ করে।

সরকার দাবি করছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং মানুষের গড় আয় বেড়েছে। তথ্য হিসেবে এতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু সেই বর্ধিত আয়ের সুফল বৃহত্তর জনগণ পাচ্ছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় বেশ কিছু অসংগতি ও বিচ্যুতি তুলে ধরা হয়েছে, যা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি রেকর্ড ছাড়াবে তাহলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে একই জায়গায় থমকে আছে কেন? ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলো থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছেন, বিদেশ থেকে প্রচুর শিল্পপণ্য আমদানিরও হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তারপরও বিনিয়োগ না বাড়া রহস্যজনক। কেবল সিপিডি নয়, আরও অনেক দেশি–বিদেশি সংস্থা প্রশ্ন রেখেছে, তাহলে টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়?

এর সঙ্গে যদি আমরা গত কয়েক বছরে বর্ধিত হারে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা জমা দেওয়ার পরিমাণটি দেখি, তাহলে টাকাগুলোর একটি ঠিকানা অনুমান করতে পারি। শুধু সুইস ব্যাংক নয়, পানামা পেপারসেও বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম এসেছে। মালয়েশিয়া ও কানাডায় অনেকের সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় নিবাসের কথাও শোনা যাচ্ছে।

২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার শুরুতে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার নিয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু করেছিল। কিছু অর্থ আদায়ও হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না। পানামা পেপারসে কয়েকজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নাম ছাপা হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কেন চুপচাপ বসে আছে, সেটাও প্রশ্ন বটে।

তবে সিপিডির গবেষণায় আরও যে উদ্বেগজনক তথ্যটি পাওয়া গেছে তা হলো, মুদ্রানীতিতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ৫ ছাড়িয়ে হয়ে গেছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকার বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের অন্যায্য সুবিধা দিলেও তাঁরা ব্যাংক সুদের হার এখনো কমাননি। ফলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনাও কম। ব্যাংক খাতে সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনিতেই দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির ফলে সেই বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে, এতে সন্দেহ নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায়। বেতন বৃদ্ধি পেলেই প্রকৃত আয় বাড়ে না। আগের বেতনে যে পরিমাণ পণ্য বা সেবা কেনা যেত, বর্ধিত বেতনে যদি তার চেয়ে কম পণ্য বা সেবা কেনা যায়, তাহলে প্রকৃত আয় কমে যায়। আমাদের সরকারগুলোর নীতি হলো, ধনীদের আরও ধনী করার পথ উন্মুক্ত করা। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কৃচ্ছ্রের বিনিময়ে হতে পারে না।

সিপিডি আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলতে চাই, গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ অর্থ যাতে নয়ছয় না হয়, সে বিষয়েও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার মধ্যে বড় কোনো কৃতিত্ব আছে বলে মনে হয় না। এই সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যের হার আরও অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য দূর করে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করা।

প্রবৃদ্ধি বাড়লে তার সুফল প্রতিটি নাগরিকের কাছেই পৌঁছাতে হবে। আয়বৈষম্য কমাতেই হবে।