বহুত্ববাদ ও হিন্দুত্ববাদের লড়াই

বর্বরতার শিকার আট বছরের শিশু আসিফা
বর্বরতার শিকার আট বছরের শিশু আসিফা

ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে যাযাবর মুসলিম সম্প্রদায়ের আট বছর বয়সী এক মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের যে খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশটির রাজনৈতিক ও নাগরিক জীবনে মানবতা ও নীতির ক্রমেই অধঃপতন ঘটছে। ক্ষমতাসীন বিজেপি এই ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বাঁচানোর চেষ্টা করায় দেশটির মৌলবাদী চরিত্র নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে শিশুটি অপহৃত হয়। তাকে এক সপ্তাহ ধরে একটি মন্দিরে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে তাকে কোনো খাবার খেতে দেওয়া হয়নি। ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করে রাখা হয় এবং উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়। এরপর নির্মমভাবে হত্যা করে একটি বনের ভেতরে তার মৃতদেহ ফেলে রাখা হয়।

জানুয়ারি মাসে এ ঘটনা ঘটলেও এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য হয়নি। কিন্তু গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রথম পাতায় এ ঘটনার লোমহর্ষক বিবরণ ছাপা হলে ভারতজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশের অভিযোগপত্র থেকে পাওয়া ওই বিবরণে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি তাঁর এই দুষ্কর্মের এক সহযোগীকে অনুরোধ করেছিলেন মেয়েটিকে একটু দেরি করে হত্যা করতে, যাতে তিনি আরও একবার তাকে ধর্ষণ করতে পারেন।

পুলিশের অভিযোগপত্র ও অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে এটা বোঝা যায়, ভারতজুড়ে যে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খেলা চলছে, তারই ফসল এই ঘটনা। এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। ভারতের ঐতিহ্যবাহী সেক্যুলারিজম এখন হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক লড়াইয়ের শিকার। আট বছরের মেয়েটি মুসলিম বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের। বাকারওয়ালরা গ্রীষ্মকালে পাহাড়ের উঁচু চারণভূমিতে এবং শীতকালে হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু এলাকার সমতলভূমিতে ভেড়া চরায়। চারণভূমিতে পশু চরানো নিয়ে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে। পুলিশের মতে, বাকারওয়ালদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা এবং তাদের এলাকাছাড়া করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই অপরাধ করা হয়েছে। এমনকি এলাকার মধ্যে শিশুটির দাফনও করতে দেওয়া হয়নি। শিশুটির মা-বাবা এখন ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।

‘হিন্দু একতা মোর্চা’ নামে নতুন একটি গোষ্ঠী এ ঘটনায় অভিযুক্তদের রক্ষা করার দাবিতে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও দুজন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। এই গোষ্ঠীর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজক বিজয় শর্মা জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপির একজন উচ্চপর্যায়ের নেতা। ওই বিক্ষোভ সমাবেশে রাজ্য সরকারের দুই বিজেপি মন্ত্রীও অংশ নেন। তারা এ ঘটনার তদন্তভার রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তরের দাবি করেছে। সিবিআই কার্যত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করে। জম্মুর আদালতের আইনজীবীরা আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলে পুলিশকে বাধা দিয়েছেন; তাঁরা ধর্ষণের শিকার শিশুটির পরিবারের পক্ষের আইনজীবীকে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন।

শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ভারতীয়রা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। কিছু শহরেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। তারা এই ভয়ংকর অপরাধের প্রতি রাজনীতিকদের সমর্থন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নীরবতায় ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ। তারা এ ব্যাপারে মুখ খুলতে এবং হিন্দু একতা মোর্চাকে যেসব মন্ত্রী সমর্থন দিচ্ছেন, তাঁদের বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আহ্বান জানান।

নরেন্দ্র মোদি অবশেষে মুখ খোলেন। তিনি বলেন, দুই দিন ধরে যেসব ঘটনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা কখনো সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না। একটি দেশ ও একটি সমাজের সদস্য হিসেবে আমরা সবাই এসব ঘটনায় লজ্জিত। মোদি ন্যায়বিচারেরও প্রতিশ্রুতি দেন। এই ভয়াবহ ঘটনায় ভারতে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও নৈতিক বিভেদ আরও গভীর হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে যখন রাজনৈতিক নেতারা অপরাধ করেন, তখন সাধারণভাবে তাঁদের বিচার হয় না। বিচার কেবল তখনই হয়, যখন এ নিয়ে জনগণ সোচ্চার হয়, প্রতিবাদ করে। সরকারের মন্ত্রী, কর্মকর্তা, ডানপন্থী গণমাধ্যম ও ডানপন্থী সমর্থকেরা এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এগুলো মিথ্যা সংবাদ এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

মোদির দলের মুখপাত্র মীনাক্ষী লেখি বিরোধীদের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে আক্রমণ করে বলেন, এরা হচ্ছে সুবিধাবাদী। একজন সাবেক প্রভাবশালী সম্পাদক টুইট করেছেন যে এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দায়ী। এক তরুণ বিজেপি কর্মী তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ধর্ষণটাতে নিশ্চয়ই বেশ ফুর্তি হয়েছে।’ পরে অবশ্যই এই পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে। একটি পর্নোগ্রাফি সাইট জানিয়েছে, ধর্ষণের শিকার মেয়েটির নাম দিয়ে ভিডিও অনুসন্ধান করা হয়েছে ব্যাপকভাবে।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পরের চার বছরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি ভারতীয় সমাজের মূলধারায় মিশে গেছে। মোদির আর্থিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে যাঁরা তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন হতাশ। কারণ, তিনি সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি। তাঁরা উল্টো সাম্প্রদায়িক ও যৌন সহিংসতা বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাকৃত নীরবতা এবং তাঁর দলের নেতা ও মন্ত্রীদের ঘৃণাপূর্ণ মন্তব্যে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করার বিষয়টি আসলেই উপেক্ষা করা খুব কঠিন।

বিজেপি ও তার হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ভারতকে এমন একটি দেশে পরিণত করেছে, যেখানে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদের সমর্থক ও সংখ্যালঘু ভারতীয়দের প্রতি বৈরিতা দিনে দিনে বাড়ছে। আট বছরের ছোট্ট মেয়েটির ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড এখন বৃহত্তর অর্থ বহন করছে। ভারত রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বহুত্ববাদী না হিন্দুত্ববাদী-এই লড়াইয়ের প্রতিফলন ঘটেছে এই ঘটনায়।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পাঠানো একটি খোলা চিঠিতে কড়াভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘আপনার দলের বিভক্তি ও ঘৃণার কর্মসূচি অলক্ষিতে আমাদের রাজনীতি, আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে।’ তাঁরা এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করেন। ভারতের সাধারণ নাগরিকদের এই লড়াই আগামী বছর অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে। বিজেপিও এ ধরনের সহিংসতার জন্য মনে হয় প্রস্তুত হয়েই আছে। ধর্মকে ব্যবহার করে নির্বাচনী সুবিধা নেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস দলটির আছে। এখন ভারতের জনগণের দায়িত্ব একটি সহিষ্ণু ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের জন্য এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিচ্যুতি থামানোর লড়াই করা।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মিতালি শরণ: নয়াদিল্লিভিত্তিক পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কলাম লেখক