অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য

আয়েশা সিদ্দিকার বই মিলিটারি ইনক্‌–এর প্রচ্ছদ
আয়েশা সিদ্দিকার বই মিলিটারি ইনক্‌–এর প্রচ্ছদ

২০০৭ সালে ড. আয়েশা সিদ্দিকা রচিত মিলিটারি ইনক্: ইনসাইড পাকিস্তান’স মিলিটারি ইকোনমি বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। এই বইয়ে পাকিস্তানেরই একজন সাহসী সন্তান আয়েশা সিদ্দিকা সে দেশের সামরিক বাহিনী কীভাবে ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা নিজেদের করায়ত্ত করেছে, সেই ইতিহাস উপস্থাপনের পর এর ধারাবাহিকতায় সত্তর বছর ধরে জেনারেলদের নেতৃত্বে আর্মি অফিসাররা পাকিস্তানের অর্থনীতিতে কীভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে, তা বিশদভাবে বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। বইয়ে মিলিটারি ইকোনমি এবং মিলিটারি ক্যাপিটালের তাত্ত্বিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিলবুজ’, যা মিলিটারি বিজনেসের সংক্ষিপ্ত রূপ। বইটির অধ্যায়গুলোর দিকে নজর দিলে বইটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। অধ্যায়গুলো ধারবাহিকভাবে নিম্নরূপ: ১. মিলবুজ-এ থিওরেটিক্যাল কনসেপ্ট; ২. দ্য পাকিস্তান মিলিটারি: দ্য ডেভেলপমেন্ট অব প্রিটোরিয়ানিজম, ১৯৪৭-৭৭; ৩. ইভল্যুশন অব দ্য মিলিটারি ক্লাস, ১৯৭৭-২০০৫; ৪. দ্য স্ট্রাকচার অব মিলবুজ; ৫. মিলবুজ: দ্য ফর্মেটিভ ইয়ারস, ১৯৫৪-৭৭; ৬. এক্সপানশন অব মিলবুজ, ১৯৭৭-২০০৫; ৭. দ্য নিউ ল্যান্ড ব্যারনস; ৮. প্রোভাইডিং ফর দ্য মেন: মিলিটারি ওয়েলফেয়ার; ৯. দ্য কস্ট অব মিলবুজ; ১০. মিলবুজ অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব পাকিস্তান। 

বইয়ের মূল থিসিস হলো, ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সিভিল আমলাতন্ত্রের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সম্মতিতে। এর পরের এক দশকে পাকিস্তানে সাতজন প্রধানমন্ত্রীর আটটি ক্যাবিনেট শিখণ্ডী হিসেবে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও সামরিক কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রই আসল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দুজন সমরপ্রভু আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খান সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিল না, তাই ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান প্রিন্স’ জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর জন্য ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের চরম পরাজয়ের গ্লানি বহনের কারণে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ভুট্টোর শাসনামলে সাময়িকভাবে প্রকাশ্য রাষ্ট্রক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেও ১৯৭৭ সালের মধ্যে তারা ভুট্টোকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে জিয়াউল হকের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা আবারও দখল করে নেয়। এর দুই বছরের মধ্যেই তারা ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে রাজনীতিকদের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। এর পরের ১৯৭৭-২০০৫ পর্বে সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রটি দখলে রেখেছে, যেখানে ৭ বছর থেকে ১০ বছর বেসামরিক শাসনের পর আবার এক দশকের সামরিক শাসনের একটা ‘চক্রাকার প্রবণতা’ পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। সামরিক শাসক জিয়াউল হক এবং পারভেজ মোশাররফ দালাল রাজনীতিবিদ, ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীদের শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করে তাঁদের একনায়কত্ব চালালেও ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত বেনজির ভুট্টো কিংবা নওয়াজ শরিফও তাঁদের শাসনামলে কখনোই মিলিটারি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার দুর্গে প্রবেশ করতে পারেননি; বরং জিয়াউল হকের আমলে পাস করা সাংবিধানিক সংশোধনীর কারণে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টকে প্রদান করার ফলে যখনই তাঁরা কোনো কারণে মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টের বিরাগভাজন হয়েছেন, তখনই সঙ্গে সঙ্গে উৎখাত হয়েছেন।
আয়েশা সিদ্দিকা ১৯৫৪-৭৭ পর্বটিকে মিলিটারি বিজনেসের গঠন পর্যায় এবং ১৯৭৭-২০০৫ পর্বটিকে বিস্তার পর্যায় অভিহিত করে বলছেন, ২০০৫ সালেই সামরিক অর্থনীতি পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে চারটি সামরিক বাহিনী-সৃষ্ট সংস্থা-ফৌজি ফাউন্ডেশন, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, শাহিন ফাউন্ডেশন ও বাহারিয়া ফাউন্ডেশন ওই দেশটির সর্ববৃহৎ চারটি ব্যবসায় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তম দুটো ফাউন্ডেশন ফৌজি ফাউন্ডেশন ও আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট স্থলবাহিনীর জন্য। আর শাহিন ফাউন্ডেশন ও বাহারিয়া ফাউন্ডেশন যথাক্রমে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর জন্য।
এগুলোর অধীনে রয়েছে কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, অ্যাগ্রো-প্রসেসিং শিল্প, খাদ্যদ্রব্য ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, এয়ারলাইনস, এভিয়েশন ফার্ম, প্রাইভেট সিকিউরিটি ফার্ম, রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল, স্কুল-কলেজ, গ্যাসস্টেশন, পেট্রলস্টেশন, বেকারি, কৃষি ফার্ম, গরুর খামার, ছাগল-ভেড়ার খামার, মুরগির খামার, রাইস মিল, সুগার মিল, মাছের খামার, ওষুধশিল্প, তেল শোধনাগার, জুতার কারখানা, বস্ত্র কারখানা, পোশাক কারখানা, পশম কারখানা, হোসিয়ারি কারখানা, হাউজিং প্রজেক্ট, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সি, পাওয়ার প্ল্যান্ট, কমার্শিয়াল প্লাজা, শপিং কমপ্লেক্স, এয়ারপোর্ট সার্ভিস, এয়ারলাইনস কার্গো, পে-টিভি, আইটি প্রজেক্ট, নিটওয়্যার কারখানা, শিপিং, সি-ফিশিং, পেইন্ট কারখানা, ড্রেজিং ফার্ম, শিপইয়ার্ড, শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ড, কোস্টাল সার্ভিস, কাটারিং সার্ভিস, ডেকোরেটর ফার্ম, কমিউনিটি হল, ডাইভিং ও সালভেজ ফার্ম, হোল্ডিং কোম্পানি এবং সড়ক-মহাসড়কের টোল সংগ্রহের ফার্ম। ফৌজি ফাউন্ডেশনের রয়েছে ২৫টি প্রকল্প, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের রয়েছে ৪১টি প্রকল্প, শাহিন ফাউন্ডেশনের ১৪টি প্রকল্প এবং বাহারিয়া ফাউন্ডেশনের আছে ১৯টি প্রকল্প-২০০৫ সালের এই ৯৯টি প্রকল্পের নামের উল্লেখ আছে বইয়ে।
২০০৫ সালেই ফৌজি ফাউন্ডেশনের সুবিধাভোগীদের সংখ্যা ৯১ লাখের বেশি ছিল। আর সরকারের খাসজমি বা হুকুমদখল করা গ্রামীণ বা শহুরে জমি ইজারা নেওয়ার ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিরঙ্কুশ অগ্রাধিকারের কারণে পাকিস্তানের সর্বত্র এখন নব্য ভূস্বামী শ্রেণি হিসেবে সামরিক অফিসাররা পাকিস্তানে অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন। সারা পাকিস্তানে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ একর জমি সামরিক বাহিনীর চাকরিরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও কর্মচারীদের মালিকানায় চলে গেছে, যা বাংলাদেশের মোট কৃষিযোগ্য জমির অর্ধেকের বেশি। পাকিস্তানের যেকোনো বড় বা মাঝারি নগরে এখন সবচেয়ে বড় আবাসিক এলাকা হয়ে গেছে একাধিক ডিওএইচএস কিংবা ডিফেন্স হাউজিং অথরিটির আবাসিক এলাকা। বইয়ের নবম ও দশম অধ্যায়ে তিনি পাকিস্তানের জন্য এহেন ‘মিলিটারি বিজনেস’-এর ‘চরম মূল্য’ এবং সুদূরপ্রসারী অভিঘাত কী হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করেছেন। এই রাষ্ট্র যে অদূর ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনীর দখলদারি থেকে মুক্তি পাবে না, সেটাই তাঁর বেদনাবিধুর উপসংহার।
আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশের সেনা এস্টাবলিশমেন্টের জন্য এ ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় কী? আমি বলতে চাই, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম গ্রহণ করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মডেল পাকিস্তান, মিয়ানমার, তুরস্ক বা ইন্দোনেশিয়া হতে পারে না। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় কিছুই নেই। শুধু পাকিস্তানের ভুলগুলো সযতনে পরিহার করতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে যে এ দেশে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি-এই দুটো রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে দুজন সমরপ্রভুর সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে। এ দুটি দলের ক্যান্টনমেন্ট-প্রীতি কারও অজানা নয়। আয়েশা সিদ্দিকার বইয়ে আরও দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামি দলটি জিয়াউল হকের সময় থেকেই আগাগোড়া সামরিক শাসনের প্রত্যক্ষ মদদদাতার ভূমিকা পালন করে চলেছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ওপর সামরিক কর্তৃপক্ষের যে প্রবল আধিপত্য বহাল রয়ে গেছে, সেটাকে ‘অতিবিকশিত রাষ্ট্রের পাশাপাশি শ্রেণিসমূহের অনুন্নয়ন’-এর ফলে উদ্ভূত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নজির হিসেবে ১৯৭১,১৯৭৩ এবং ১৯৭৫ সালেই তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী হামজা আলভি। কার্ল মার্ক্সের ‘রিলেটিভ অটোনমি অব দ্য স্টেট’ ধারণার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে স্বাধীন হওয়া উত্তর-ঔপনিবেশিক তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে কেন সামরিক একনায়কেরা কিছুদিন পরপর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হামজা আলভির ওই তত্ত্বে ‘অতিবিকশিত রাষ্ট্রের পাশাপাশি শ্রেণিসমূহের অনুন্নয়নকে’ মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। আয়েশা সিদ্দিকার বইয়েও গুরুত্বের সঙ্গে হামজা আলভির এই তত্ত্বের উল্লেখ রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের মিলিটারি অফিসারদের একটি ‘ইনডিপেনডেন্ট মিলিটারি ক্লাস’ হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন। পাকিস্তানের আরেক লেখক ড. আয়েশা জালালের বেশ কয়েকটি বিশ্বখ্যাত গ্রন্থেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী কীভাবে সে দেশে ÿক্ষমতা দখল করেছিল, তার প্রামাণ্য বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোরও রেফারেন্স রয়েছে আয়েশা সিদ্দিকার বইয়ে। এই সাহসী রাজনীতি বিজ্ঞানীর লেখা আমাদের রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ সচেতন নাগরিকদের অবশ্যই পড়া প্রয়োজন।

ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক