মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও কোটা সংস্কার

শুভবুদ্ধি বজায় থাকুক। সব পক্ষেরই শুভবুদ্ধি যদি জারি থাকে, তাহলে সবার ভালো। দেশের ভালো, মানুষের ভালো, গণতন্ত্রের ভালো আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই জয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে চিরস্মরণীয় এক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’

জাতির জনকের চেয়ে স্বাধীনতার তাৎপর্য সুন্দর করে বলতে পারবেন আর কে?

১৪২৫ সনের পয়লা বৈশাখে এই কলামেই একটা তথ্য উল্লেখ করেছিলাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে এ দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ। আর বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার।

আরেক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর কর্মবাজারে কাজপ্রত্যাশী মানুষ প্রবেশ করে প্রায় ২০ লাখ। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, কেন কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সারা বাংলাদেশের অজস্র অগণিত তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।

এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ১০ জানুয়ারির ভাষণের শেষ বাক্য দুটি আরেকবার পড়ুন।

স্বাধীনতাকে যদি আমরা অর্থবহ করতে চাই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা যদি গড়তে চাই, তাহলে এ দেশের তরুণসমাজকে সঙ্গে নিতে হবে। ইংরেজিতে বলে, ‘অন বোর্ড’ নিতে হবে। তার বাংলা করলে দাঁড়াবে, তাদেরও জাতীয় অগ্রগতির, আশা-আকাঙ্ক্ষার তরণিতে নিতে হবে। যেন আমাদের দেশচালক প্রবীণেরা আর দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি তরুণ-যুবারা একই তরণিতে উঠে গেয়ে উঠতে পারে, ‘আমরা যাত্রী একই তরণির, সহযাত্রী একই তরণির।’

সে ক্ষেত্রে টেবিলের এই পাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের পড়তে পারতে হবে টেবিলের ওই পাশে যাঁরা আছেন তাঁদের মনের কথা। মঞ্চের ওপরে যাঁরা আছেন, মাইক্রোফোনের সামনে যাঁরা আছেন, তাঁদের জানতে পারতে হবে সেই তরুণ-তরুণীরা কী চান, যাঁরা আছেন মঞ্চের নিচে, মঞ্চ থেকে দূরে যাঁরা আছেন, যাঁরা আছেন পাদপ্রদীপের আলো থেকে যোজন যোজন দূরে, দিনাজপুরে কিংবা কক্সবাজারে, রামুতে কিংবা বীরগঞ্জে। তাঁদের চাওয়ার সঙ্গে তাঁদের পাওয়াটাকে যদি মেলাতে না পারি, তাহলে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যায় না। তাতে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তা সরকারের নিজের জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না। সবাই নিজের ভালো বোঝে, সরকার, সরকারি দল, সরকারের পরামর্শকেরা, বার্তাবাহকেরা, নীতিনির্ধারকেরা নিজের ভালো বোঝেন না?

কোটা ব্যবস্থার সংস্কার আন্দোলন দমনের প্রথম দিককার চেষ্টা-বল প্রয়োগ করা, দলীয় ছাত্রকর্মীদের নামিয়ে দেওয়া-এসব থেকে মনে হচ্ছিল আজকের তরুণদের মনের কথাটা ক্ষমতাসীনেরা বুঝতেই পারছেন না। সেটা খুব ভালো লক্ষণ নয়।

সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে বাস্তবতাবোধ কাজ করে।

প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণ দেন। তাতে একটা সূত্র আছে, তিনি কমিটি করে দেবেন, কমিটি কাজ করবে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করে কোটা তুলে দেওয়া যায়, তা সেই কমিটি দেখবে।

আমাদের পরামর্শ হলো কোটা বিলোপ নয়, কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করুন। উপজাতীয় কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, নারী কোটা থাকতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাও সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে। এ বিষয়টা যাঁরা ভালো বোঝেন, সেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিশ্চয়ই নেওয়া হবে।

শুভবুদ্ধি জারি থাকুক। কথাটা আবারও বলতে হচ্ছে, কারণ ক্যাম্পাসে পুলিশের তৎপরতা, সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটা অংশের ছেঁড়াখোঁড়া কথাবার্তা, ছাত্রসংগঠনের মোটরসাইকেল মহড়াকে কেবল সিঁদুরে মেঘ বলে মনে হচ্ছে না।

ক্ষমতা অনেক সময় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, মাঠের বাস্তবতা তাকে বুঝতে দেয় না। আবারও বলি, শুভবুদ্ধি বজায় থাকুক। সর্বমহলই হাসিমুখে সন্তুষ্ট চিত্তে ঘরে ফিরে যাক। সবাই যার যার কাজে নিয়োজিত থাকুক। তাতে সবারই মঙ্গল।

২.
মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশ দিয়েছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছি বলে আজ সর্বক্ষেত্রে আমরা ভালো করছি। স্বাধীনতা না পেলে আজ বাংলার চেয়ে উর্দুর চর্চা করতে হতো বেশি, সাকিব আল হাসান কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজা দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের পানির বোতল টানতে পারতেন কি না, সন্দেহ। কাজেই মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা সব সময় সর্বোচ্চ সম্মান জানাব। আমার পরামর্শ হলো, ডেটাবেইস তৈরি করে প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হোক। কোন পরিবারের কী প্রয়োজন, সে অনুযায়ী তাদের রাষ্ট্র সহযোগিতা করুক। বহু পরিবার পাওয়া যাবে, যারা কিছুই চাইবে না। কিন্তু তাদের আমরা যেন বিতর্কের মধ্যে ফেলে না দিই।

শহীদ ফারুক ইকবালকে নিয়ে যে কিংবদন্তি আছে, সেটা বলি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ঢাকার মালিবাগের কাছে আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্রনেতা ফারুক ইকবাল মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ‘এক দফা এক দাবি, স্বাধীনতা’ স্লোগানে কাঁপছে আকাশ-বাতাস। তাঁরা মিছিল নিয়ে যাবেন পল্টনে, বঙ্গবন্ধুর জনসভায়। রামপুরায় মিলিটারিরা গুলি চালাল। রাজপথে লুটিয়ে পড়ল ফারুক ইকবালের দেহ। পানি পানি। কেউ একজন ছুটল পানি আনার জন্য। পানি আনতে আনতেই দেখা গেল, নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ফারুক ইকবালের দেহ, আর এই পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ফারুক ইকবাল নিজের বুকের রক্তে আঙুল ডুবিয়ে রাজপথে লিখে রাখার চেষ্টা করছেন, ‘জয় বাংলা’।

সেই ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তো হারিয়েই যাচ্ছিল। তখন মনে হতো, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সেই গান কেন প্রাণে প্রাণে বেজে উঠছে না, ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ওঠে রণি-বাংলাদেশ।...“জয় বাংলা” বলতে মনরে আমার এখনো কেন ভাবো, আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব, অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।’

সারা বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ-ছাত্র আর ছাত্রী-কেউ সাহিত্যের, কেউ গণিতের, কেউবা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের, কেউ বেসরকারি, কেউ সিলেটের কেউবা রাজশাহীর-মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের-কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেমে একযোগে স্লোগান ধরে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় উন্নীত করবে তো এই কোটি কোটি তরুণই।

৩.
শার্লক হোমস বললেন, ‘ডা. ওয়াটসন, ওপরে তাকান। কী দেখতে পাচ্ছেন?’

ওয়াটসন বললেন, ‘আকাশে অনেক তারা।’

‘এর মানে কী?’

‘কাল দিনের বেলা রোদ উঠবে, আকাশ মেঘমুক্ত।’

শার্লক হোমস বললেন, ‘হয়নি। এর মানে হলো আমাদের তাঁবুটা চুরি হয়ে গেছে।’

আপনি যেকোনো জেলা শহর, থানা শহরের রাস্তা-গলিতে যান। আকাশে তাকান। কী দেখতে পাবেন? পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন-সবই শিক্ষাসংক্রান্ত। কোচিং সেন্টার, স্কুল-কলেজ, ছাত্র চাই। ইংরেজি শেখাব। ম্যাথ পড়াব। ইত্যাদি।

দেশজুড়ে আরেকটা বিপ্লব শুরু হয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে কোটি কোটি প্রান্তিক পরিবার ভাগ্য বদলাতে চাইছে। সেই পরিবারগুলোকে, সেই তারুণ্যকে একই তরণিতে যদি নিতে না পারেন, আমাদের প্রজন্মের কান্ডারিরা সবচেয়ে বড় ভুলটা করবেন।

আর যদি নিতে পারেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে।

কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের প্রশ্নটি তাই সুন্দরভাবে সহজভাবে সমাধান করুন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক