এই শাস্তি কীভাবে ঠিক হলো?

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

একের পর এক অস্থির ও অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল সম্পর্কে যা কিছু জানতে পারছি, তা খুবই কষ্টের। হলটি আমার মায়ের নামে, এ জন্য গণমাধ্যমে হলের নাম উল্লেখ করে যখন একেকটি দুঃখজনক ঘটনার খবর দেখি বা শুনি, তখন মনটা বিশেষভাবে খারাপ হয়ে যায়।
গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে কয়েকজন ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিয়েছে। এ জন্য আবাসিক শিক্ষকেরা মেয়েদের মোবাইল ফোন তল্লাশি করেছেন। কয়েকজনের ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমগুলোতে ছাত্রী হল প্রশাসনের এই ভূমিকার কথা জেনে হতবাক হয়েছি। তাদের সময়জ্ঞান, বিবেচনাবোধ এবং বিচারের ধরন শুনে যে কেউ বিস্মিত হবেন। একজন ছাত্রী আন্দোলন করলে, ভুয়া স্ট্যাটাস দিলে বা যেকোনো অপরাধ করলে তাকে মধ্যরাতে হল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবছি। আমি ভেবে পাই না, এত তাড়াহুড়া করে এমন পদক্ষেপ কেন নেওয়া হলো।

এর আগে অবিশ্বাস্য সব দ্রুততার সঙ্গে সুফিয়া কামাল হল, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি ছাত্রলীগ থেকে একের পর এক বহিষ্কারের নানা ঘটনা ঘটেছে। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনসহ নিয়মতান্ত্রিক যেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা, সেগুলো অনুসরণ করা হয়েছে বলে শুনিনি। বলতে কষ্ট হয়, ছাত্রলীগের একজন নেত্রীকে গলায় জুতার মালা পরানো হলো, লাঞ্ছিত করা হলো। এগুলো শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছি।

বিশ্ববিদ্যালয় উৎকর্ষ সাধনের জায়গা। কোনো সভ্য সমাজে এমন সব কাণ্ড চলতে পারে না। অথচ দীর্ঘদিন আমরা এমন সব ঘটনা প্রশ্রয় দিয়ে আসছি। কারও ওপর রাগ হলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে, ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করতে হবে, ফতোয়া দিয়ে নারীর জীবন বিপন্ন করতে হবে-এগুলো এখনো ঘটছে অহরহ। আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে বা থামাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা যথেষ্ট নয়। এ জন্যই এসব অন্যায় হচ্ছে। আবার এগুলো যে অন্যায়, সেই বোধও সমাজ থেকে চলে গেছে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যারা দুর্বল, বিশেষ করে নারীদের ওপর অন্যায়টা বেশি মাত্রায় হচ্ছে। 

অবশ্য ছাত্রলীগের হল শাখার সেই নেত্রী দুর্বল ছিল না। তবে সে যখন বিপদে পড়ল তখন হল কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি ছাত্রলীগ কেউই তার পাশে দাঁড়ায়নি। সবাই বহিষ্কার করেছে। পরে অজ্ঞাত কোনো কারণে অন্য একটি চেহারা বা চিত্র নিয়ে সে সামনে এল। তখন দেখা গেল, আগের ঘটনা উল্টে দিয়ে পূর্ণ মর্যাদায় তাকে হল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রলীগ পুনর্বাসন করল। এরপরের ঘটনাগুলো আরও অবিশ্বাস্য।

আমার মতে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মতান্ত্রিক ধারা বজায় না রেখে যেসব পদক্ষেপ একের পর এক গ্রহণ করল, সেগুলো কোনো প্রতিষ্ঠানের গৃহীত বিধান হতে পারে না। যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যে কারও দ্বারা অন্যায় বা অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। সেই প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট বিধিবিধান মেনেই অন্যায়ের প্রতিকার করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কি তা করেছে বা করছে?

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো বিধান থাকতে পারে না, যেসব বিধান অনুযায়ী মধ্যরাতে ছাত্রীদের তাদের স্থানীয় অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। প্রশ্ন জাগে, অভিযুক্ত ছাত্রীরা এমন কী বিপজ্জনক কাজ করেছে যে ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তাৎক্ষণিক তাদের হল থেকে বের করে দিতে হবে এবং কী প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত হলো যে এই শাস্তিটাই তাদের প্রাপ্য। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার রাতের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হওয়ায় রাস্তাঘাটে যানবাহন ছিল না বললেই চলে। অনেক এলাকা ছিল বিদ্যুৎবিহীন। এর মধ্যে ছাত্রীদের অসহায় অবস্থায় রাস্তায় নামার ছবি দেখা গেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

এসব ছাত্রীর মোবাইল ফোন তল্লাশি বা বাজেয়াপ্ত কোন বিধিবিধানের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বা হল কর্তৃপক্ষ করেছে, তা জানা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, একটি প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠানের হেফাজতে থাকা মেয়েদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে কি না, যা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারত।

এই ছাত্রীদের দুজনকে তাদের স্থানীয় অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় অভিভাবকেরা সাধারণত তাদের পরিবারের সদস্য নন। এলাকার বা দূরসম্পর্কের আত্মীয়, অনেক সময় স্থানীয় অভিভাবক হয়ে থাকেন। কারণ, সব ছাত্রীর অভিভাবক ঢাকায় থাকেন না। তাঁরা যে এই ছাত্রীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বা সম্মান নিশ্চিত করবেন, তা সবক্ষেত্রে না-ও হতে পারে। এসব ছাত্রীর সামাজিক অবস্থার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

আমরা জানি, সূর্যাস্তের পর আইন অনুযায়ী কোনো নারীকে পুলিশ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারে না। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ তার হেফাজতে থাকা নারীদের গভীর রাতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে কী করে আশ্রয়চ্যুত করতে পারে, সেটা বোধগম্য নয়। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা নিজেরাও এ ব্যাপারে সুবিবেচনার ওপর ভিত্তি করে এই কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। এ ছাড়া ঘটনাপ্রবাহের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে যার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোর প্রতিকার করবেন, দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করবেন। তা না হলে একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়ের জন্ম দেবে এবং এর শেষ কোথায়, কীভাবে হবে তা আমরা জানি না।

এই ঘটনাগুলো দেখে বা শুনে আমরা বিপর্যস্ত বোধ করছি। কারণ, ঘটনাগুলো ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে, যার অতীত ইতিহাস আমাদের গর্বের ভিত্তি। এই প্রতিষ্ঠানকে অমর্যাদাকর এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেওয়া আমার মতে গুরুতর অপরাধের শামিল।

অবশ্য এ রকম নানা ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। প্রশ্নবিদ্ধ, পক্ষপাতদুষ্ট এবং বেআইনি কাজের ফল কখনোই ভালো হয়নি। এ ধরনের একটি অন্যায় বা অপরাধ আরও দশটি ঘটনার জন্ম দেয়। তাই আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এসবের অবসান চাই, সুষ্ঠু সমাধান চাই।

লেখক: মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা